গুরুত্বপূর্ণ দুই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন সংগঠনে রক্তসঞ্চারের সময়, তখন বারবার নজর চলে যাচ্ছে দক্ষিণ চিন সাগরে মার্কিন রণতরীর দিকে! দলের রাজ্য কমিটির দৈনিক মখুপাত্র গত কালও বিরাট গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে চিনের প্রতিবাদের খবর! অথচ সিপিএমের প্লেনামের আগে দলের পলিটব্যুরোর তৈরি করা রিপোর্টেই উঠে এল আন্দোলনের বিষয়বস্তু বাছতে ভুলের কথা। যার ফলে দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে জরুরি বিষয় ছেড়ে সাম্রাজ্যবাদের মতো তাত্ত্বিক প্রশ্নে বেশি মাথা ঘামালে সংগঠন আম জনতার কাছাকাছি পৌঁছবে কী করে!
আগামী ডিসেম্বরে কলকাতার প্লেনামের আগে দিল্লিতে দু’দিনের পলিটব্যুরো বৈঠকের আলোচনায় উঠে এসেছে, রাজনৈতিক ভুলভ্রান্তির চেয়েও সংগঠনের দুর্বলতার জন্যই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না সিপিএম। সংগঠনকে চাঙ্গা করার দাওয়াই হিসেবে সর্ব স্তরের কমিটিতে যত বেশি সম্ভব তাজা রক্তের আমদানির প্রস্তাব দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। কিন্তু দলের মধ্যেই একাংশ প্রশ্ন তুলছেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে শক্তিক্ষয় করতে থাকলে সংগঠন ঘুরে দাঁড়াবে কী ভাবে? অভিমুখ ঠিক না থাকলে তাজা রক্ত এনেও কি খুব কাজের কাজ হবে?
অথচ এমন নয় যে, বিষয়টি সিপিএম নেতৃত্বের কাছে একেবারে অজ্ঞাত! প্লেনামে আলোচনার জন্য দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট ও প্রস্তাবের খসড়া চূড়ান্ত করেছে পলিটব্যুরো। সেই রিপোর্টের মূল বক্তব্য, দলের গণসংগঠনগুলি মানুষের রোজকার সমস্যা নিয়ে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। অনেক সময় আন্দোলনের বিষয় বাছতেও ভুল হচ্ছে। স্থানীয় সমস্যার বদলে অন্য বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই সূত্রেই দলের মধ্যে একাংশের বিস্ময়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতো বিষয়ে মিছিল করে কার লাভ? যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কী সম্পর্ক, তা বোঝানোই কঠিন! দলের নেতাদের বক্তব্য, আর্থিক উদারীকরণের ফলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও পাল্টে গিয়েছে। এখন মধ্যবিত্ত ঘরের অনেক ছেলেমেয়েই আমেরিকায় গিয়ে চাকরি করছে। অথচ দলের নেতারা সেই মধ্যবিত্তের বাড়িতে গিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিপদ বোঝানোর চেষ্টা করছেন! এই স্ব-বিরোধিতা নিয়েই প্লেনামের মুখোমুখি হচ্ছে সিপিএম।
সাংগঠনিক খসড়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে দুই বাম দুর্গ পতনের পরে গোটা দেশেই সংগঠনের দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সাংগঠনিক জোর নেই বলে কোনও রাজনৈতিক কৌশলই তেমন কাজে দিচ্ছে না। দলের এক পলিটব্যুরো নেতা বলেন, ‘‘সাংগঠনিক জোর থাকলে ভুল রাজনৈতিক চালও ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু জোর না থাকলে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিকঠাক রণকৌশল তৈরি করেও কোনও লাভ হয় না!’’
গত এপ্রিলে বিশাখাপত্তনমে পার্টি কংগ্রেসের পরেই প্রতিটি রাজ্য নেতৃত্বের কাছে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছিল। দলের সংগঠন কী ভাবে কাজ করছে, কোন বিষয়ে আন্দোলন হচ্ছে, সেই আন্দোলনে দলের কর্মীদের বাইরে কত মানুষ যোগ দিচ্ছেন, এই সব জানতে চাওয়া হয়েছিল। তার ভিত্তিতেই সাংগঠনিক রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। এই রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করেই আগামী দিনের রণকৌশল সম্বলিত একটি প্রস্তাব তৈরি করছেন সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরি। আগামী ১৩-১৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে তিনি ওই প্রস্তাব পেশ করবেন।
এই প্রস্তাবের অন্যতম প্রধান বক্তব্য, দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে যত বেশি সম্ভব তাজা রক্ত বা নতুন মুখ নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে, নিচু তলার কমিটিতে তরুণদের নিয়ে আসার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও দলের মধ্যে বৃদ্ধতন্ত্রের অবসানের লক্ষ্যে প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে এখনই কোনও বয়ঃসীমা বেঁধে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না বলেই সিপিএম সূত্রের খবর। কারণ, এখনই বয়ঃসীমা বেঁধে দিলে অনেক জায়গাতেই স্থানীয় কমিটি গঠন করা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। সব জায়গায় সংগঠনে সেই রকম উপযুক্ত তরুণ নেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় যেমন এই সমস্যা হবে, তেমনই বাংলা-ত্রিপুরা-কেরলের বাইরে কমিটি করাও কঠিন হবে।
ইয়েচুরির তৈরি প্রস্তাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাষা, স্লোগান, আন্দোলনের বিষয়কে সময়োপযোগী করার কথাও বলা হচ্ছে। মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষকদের উপরে আর্থিক উদারীকরণের কী প্রভাব পড়েছে, তা খতিয়ে দেখতে তিনটি কমিটি তৈরি হয়েছিল। সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই নতুন স্লোগান, আন্দোলনের ভাষা বেছে নেওয়া হবে। ‘সাম্রাজ্যবাদ দূর হঠো’ জাতীয় মান্ধাতার আমলের ধারণা থেকে সিপিএম শেষ পর্যন্ত বেরোতে পারবে কি না, সেটাই অবশ্য বড় পরীক্ষা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy