প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
প্রজাতন্ত্র দিবসের আগেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর ধারা তৈরি করে ফেলতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। যাতে ভোট ঘোষণার আগেই ওই আইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলি থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব প্রদান শুরু করা সম্ভব হয়। সূত্রের মতে, দেশের শাসক শিবির পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওই নাগরিকত্ব প্রদানের কাজ শুরুর পক্ষপাতী। বিরোধীদের বক্তব্য, ভোটের আগে মেরুকরণকে ‘অস্ত্র’ করতেই সিএএ নিয়ে এ ভাবে সক্রিয় পদ্ম শিবির।
সিএএ যে হেতু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, স্বভাবতই এ নিয়ে সরগরম এ রাজ্য। তৃণমূলের অভিযোগ, সিএএ নিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করছে বিজেপি। আর সিপিএমের বক্তব্য, ভোটের আগে কাগজ নিয়ে একটা হইচই তৈরি করতে চাইছে পদ্ম শিবির। বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে বিজেপি বলছে, মানুষ এই আইন গ্রহণ করেছেন।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার দিল্লির মসনদ দখল করেই সিএএ আইন পাশ করায় মোদী সরকার। ওই আইনানুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে যদি কোনও ধর্মীয় সংখ্যালঘু (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টান) উৎপীড়নের কারণে এ দেশে আসেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের আশ্রয় দেবে ভারত। কেন ওই তালিকায় মুসলিমদের নাম নেই, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পথে নামে একাধিক সংখ্যালঘু সংগঠন ও বিরোধীরা। যে বিরোধের কারণে সে সময়ে ওই আইন রূপায়ণ থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল কেন্দ্র। তার পরে চার বছর কেটে গেলেও, ওই আইনের ধারা এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি সরকার।
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে নাগরিকত্বের দাবিতে সরব বাংলাদেশ থেকে আসা মতুয়া সমাজ। গত বার তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে ওই সমাজের ঢালাও সমর্থন পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু মাঝের চার বছরে সিএএ প্রশ্নে কার্যত হাত গুটিয়ে থাকায় ক্ষুব্ধ মতুয়াদের একটা বড় অংশ। গত কাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি শীর্ষ সূত্র থেকে দাবি করা হয়, খুব দ্রুত ওই আইনের ধারা তৈরি করা হবে। সব ঠিক থাকলে আগামী ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের আগেই ওই ধারা তৈরি হয়ে যাবে। যাতে ভোট ঘোষণার আগে অন্তত এক জন মতুয়াকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ সেরে ফেলা যায়। তাতে মতুয়া সমাজকে বার্তা দেওয়া সম্ভব হয়।
বিরোধীদের মতে, গোটা তৎপরতাটাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে। ভোট শেষ হলেই তাতে ভাঁটা পড়বে। তা ছাড়া ধর্মের ভিত্তিতে কী ভাবে কাউকে নাগরকিত্ব দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারি। তাঁর কথায়, ‘‘সংবিধানের মূল ভিত্তি হল ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই কী ভাবে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব? তা ছাড়া বিষয়টি এখনও সুপ্রিম কোর্টের বিচারধীন। যত ক্ষণ না দেশের শীর্ষ আদালত এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না নেয়, তত দিন ওই আইনের মাধ্যমে কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়া সাংবিধানিক ভাবে অনৈতিক।’’ কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘২০১৯-এ মোদী সরকার ওই আইনকে বুলডোজ় করেছিল। ছ’মাসের মধ্যে তা সংসদীয় রীতি মেনে কার্যকর করা উচিত ছিল। কিন্তু এখন এটা পরিষ্কার যে, এটা মেরুকরণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘সিএএ নিয়ে ফের দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, বাংলায় এই আইন কার্যকর হবে না। এখানে বসবাসকারীরা ইতিমধ্যেই নাগরিক। ফলে এই আইনের কোনও প্রয়োজন নেই।’’ হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভেদ উস্কে দিতেই ওই পদক্ষেপ বলে মনে করছেন আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের যদি নাগরিকত্ব দেওয়ার সদিচ্ছা থাকত, তা হলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ৬এ নম্বর ধারায় সঙ্গে ৬এ বাই এক নম্বর ধারা যুক্ত করলেই হয়ে যেত। তা না করে কেন্দ্র এনআরসি-র কথা বলল। ক্রোনোলজি বোঝাল। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করল।” রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “আদালতে যাক। ক্ষমতা থাকলে আটকে দেখাক। মানুষ সমস্ত প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে এই আইন গ্রহণ করেছেন। তৃণমূলের যে সব কর্মী সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকেন, তাঁরা এই আইনকে স্বাগত জানান। উনি (শশী) দলের মধ্যে গণভোট করুন। জামানত জব্দ হবে।” রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘সিএএ চালু হবেই। পৃথিবীতে যে ভাবে হিন্দুরা অত্যাচারিত হচ্ছে তাতে সিএএ চালু ছাড়া উপায় নেই।’’ বিষয়টি নিয়ে বিজেপির অন্দরেও চর্চা জারি পুরোদমে। তাতে আজ ইন্ধন জুগিয়েছেন বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। তিনি অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতিও বটে। তিনি উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর থানার চৌবেড়িয়া এলাকায় দলীয় কার্যালয়ের উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। সেখানে সংবাদমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করেন, ‘‘২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের প্রচারে বলেছিলাম, আপনারা আমাদের ভোট দিয়ে জেতান। আমরা সিএএ পাশ করেদেখাব। কিন্তু কখনও বলিনি, সিএএ কার্যকর করে দেখাব।’’
কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী আজ বলেন, ‘‘২০১৯ সালে ভোটের প্রচারে মানুষের কাছে এ রকম কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল না যে ২০২৪ সালের আগেই সিএএ কার্যকর হবে। কখনও বলিনি, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগেই সিএএ কার্যকর করতে হবে। ২০১৯ সালের প্রতিশ্রুতি মতো সিএএ পাশ হয়েছে। আইন হয়েছে। ভারতের সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’’ শান্তনুর আশা, লোকসভা ভোটের আগেই সিএএ কার্যকর হয়ে যাবে।
শান্তনুর বক্তব্যের সমালোচনা করে অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা বনগাঁর প্রাক্তন সাংসদ মমতা ঠাকুর বলেছেন, ‘‘শান্তনু ২০১৯ সালে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বিজেপি নেতারা ভোটের আগে ফের ভাঁওতা দিতে শুরু করেছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy