Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

ভোররাতে কাঁপল মণিপুর, ঘুম ছুটে থরহরি এ রাজ্যেও

আগেও অনেক বার এসেছি পাহাড় ঘেরা এই শহরে। কিন্তু এমন কম্পিত আতঙ্কিত ইম্ফলকে আগে দেখিনি। স্বাভাবিক। ১৯৫০ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে কেটে গিয়েছে সাড়ে ছয় দশক। এর মধ্যে খুচরো কম্পন অনেক হলেও এত বড় ভূমিকম্পের ‘নাড়া’ এই প্রজন্ম খায়নি।

সইকুল সুপারমার্কেট। —নিজস্ব চিত্র।

সইকুল সুপারমার্কেট। —নিজস্ব চিত্র।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
ইম্ফল শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫৬
Share: Save:

আগেও অনেক বার এসেছি পাহাড় ঘেরা এই শহরে। কিন্তু এমন কম্পিত আতঙ্কিত ইম্ফলকে আগে দেখিনি। স্বাভাবিক। ১৯৫০ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে কেটে গিয়েছে সাড়ে ছয় দশক। এর মধ্যে খুচরো কম্পন অনেক হলেও এত বড় ভূমিকম্পের ‘নাড়া’ এই প্রজন্ম খায়নি।

অন্য সময়ে সন্ত্রাস-বিধ্বস্ত এই শহরের বিমানবন্দরে নামলেই সামরিক পোশাক আর কালাশনিকভের কড়া নজর থাকে যাত্রীদের উপরে। রানওয়েতে নেমে ক্যামেরা বের করা তো দূরের কথা, তুলিহাল বিমানবন্দরের বাইরে থেকে বিমানবন্দর ভবনের ছবি তুললেও তাড়া খেতে হয়। কিন্তু আজ বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীরাই আশপাশের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। মূল ভবনের চূড়ায় বিরাট ফাটল বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে। ফাটলের চিহ্ন আশপাশের দেওয়ালেও। উত্সাহী যাত্রীদের অনেকেই মোবাইল বের করে যথেচ্ছ ছবি তুললেন। নেই ধমক, নেই চোখরাঙানি।

বিমানবন্দর থেকে বেরোলেই সাধারণত অটোচালকদের চেনা প্রশ্ন ধেয়ে আসে— হোটেল? আজ সাংবাদিক দেখে তাঁরাই হাঁকছেন, ‘‘হসপিটাল? আর্থকোয়েক?’’ ভোর ৪টে ৩৫ মিনিটে ৬.৮ রিখটার স্কেলে তীব্র কম্পনের পরে ৩.৫ রিখটার স্কেলের আরও দু’টি আফটারশকে কেঁপেছে ইম্ফল। অটোওয়ালারাও জানেন, গন্তব্য আজ বদলাতে বাধ্য।

এ দিনের কম্পনের অভিকেন্দ্রই ছিল ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে, মায়ানমার সীমান্তের কাছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ জানিয়েছেন, কম্পনের উৎস ছিল ভূপৃষ্ঠের ৫৫ কিলোমিটার নীচে। যদিও মৌসম ভবনের মতে, মাটির তলায় মাত্র ১৭ কিলোমিটার গভীরে ছিল কম্পনের উৎস। স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গ, অসম, অরুণাচল, মিজোরাম, আগরতলাতেও তার ধাক্কা লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গে তিন জন আতঙ্কে মারা গিয়েছেন। বাংলাদেশেও তিন জনের মৃত্যুর খবর
পাওয়া গিয়েছে। মণিপুরে মৃত ৭, আহত শতাধিক।

ইম্ফল শহরের দিকে এগোতেই নজরে পড়ল বিভিন্ন জায়গায় ফাটলের চিহ্ন। মেনুথাং সেতুতে আড়াআড়ি বিরাট ফাটল। শহরের প্রাণকেন্দ্রে থঙ্গল বাজার আর ইমা কাইথেল। ইমা হল এশিয়ার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে পুরনো মহিলা পরিচালিত বাজার। অন্য দিনের জমজমাট কেনাবেচা আজ উধাও। বাজারের ২ ও ৩ নম্বর ভবনে বিরাট ফাটল। সে দিকে তাকিয়ে মহিলাদের জটলা। সরানো হচ্ছে মালপত্র। থামগুলো ভেঙে বেরিয়ে এসেছে লোহার খাঁচা। মণিপুর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভবন আর বিএসএনএল ভবনের প্রথম তলেও ফাটলের চেহারা ভয় ধরানো। তামেংলংয়ের বাসিন্দা সিলভিয়া, থৌবাল-এর ডেভিডরা আপাতত

ইম্ফলে। ভোরের আতঙ্কের রেশ এখনও তাঁদের গলায়। বলছিলেন, ‘‘প্রথমে ভেবেছিলাম রাস্তার পাশেই বাড়ি। বড় ট্রাক যাওয়ায় হয়তো বাড়ি
কাঁপছে। কিন্তু ভুল ভাঙতেই বাড়ির সকলকে টেনে কোনও মতে রাস্তায় এসে নেমেছি।’’ ইম্ফলে রাতের তাপমাত্রা এখন নেমে যাচ্ছে ৫ ডিগ্রিতে। ভয়ের চোটে ঠান্ডার কামড়ও টের পাননি সিলভিয়া, ডেভিডরা।

প্রেস ক্লাবে এসে দেখলাম, নবনির্মিত বহুতলের একতলার দেওয়াল জুড়েও অজস্র ফাটলের চিহ্ন। ইম্ফলের রিমস হাসপাতালও ভাল রকম ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু সে দিকে তাকানোর সময় কোথায়? সকাল থেকে একের পর এক গাড়ি ঢুকছে হাসপাতালে। নিয়ে আসা হচ্ছে আহতদের। কারও মাথায় ভেঙে পড়েছে ছাদ, কারও পা ভেঙে ঝুলছে। কারও ফাটা মুখ হাসপাতালের বারান্দাতেই সেলাই করছেন নার্সেরা। মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইবোবি সিংহ হাসপাতালে এসে বললেন, ‘‘এত বড় বিপর্যয় আগে দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করে খবর নিয়েছেন।’’ জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দু’টি দলও এসে পৌঁছেছে। মৃতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও প্রথম সুযোগেই ঘোষণা করেছেন ইবোবি। ভূমিকম্পের পরেও আজ সকালে ইম্ফলে নিয়মমাফিক স্কুল-কলেজ খুলেছিল। কিন্তু মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে রাজ্যের সব স্কুল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের বিভিন্ন দফতর, স্টেশন থেকে ক্রমাগত ক্ষয়ক্ষতির খবর আসছে। আলিপুরদুয়ারে ১২টি, রঙিয়া ডিভিশনে ৮টি, লামডিং ডিভিশনে ১০টি, তিনিসুকিয়ায় ১১টি, কাটিহারে ১৫টি ট্রেনকে আজ থামিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ মিনিট থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত আটকে থাকে ট্রেনগুলি। ইঞ্জিনিয়াররা সব লাইন, সেতু পরীক্ষা করার পরই ফের ট্রেন চলার অনুমতি দেন।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ আজ গুয়াহাটিতে ছিলেন। ভোরে কম্পন টের পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন তিনিও। সকাল হতেই উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। তদারকি করেন ত্রাণকাজে। ক্ষয়ক্ষতি তুলনায় বেশিই হয়েছে অসমে। গুয়াহাটি শহরের শতাধিক বহুতলে ছোট-বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। পুরসভা বিপজ্জনক বহুতলগুলি থেকে আবাসিকদের অন্য জায়গায় চলে যেতে অনুরোধ করেছে। আতঙ্কে মারা গিয়েছেন অসুস্থ দুই ব্যক্তি। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আহতদের দেখে এসেছেন। সোনাই সার্কেলের অনেক বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। বঙাইগাঁও জেলাশাসকের দফতর ও নাভার্ড মেন্টাল হেল্থ হাসপাতালে ফাটল। ডিব্রুগড় মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল, শিবসাগরের পর্যটন ভবন আর শ্রম দফতর, নগাঁও জেলায় বহু স্কুল ও রেল আবাসনে ফাটল ধরেছে।

মণিপুর অপেক্ষাকৃত কমে রক্ষা পেল কী করে? অন্য দিন রাজ্যের দারিদ্র্যের জন্য সরকারকে গাল পাড়েন এখানকার মানুষ। এ দিন স্থানীয় ব্যবসায়ী এন ববিচাঁদ বলছিলেন, ‘‘গরিব হওয়াতেই বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচল রাজ্যটা।’’ যেখানে কম্পনের মূল কেন্দ্র, সেই তামেংলং-নোনে জঙ্গল এবং পাহাড় ঘেরা গ্রামীণ জনপদ। সেখানে ৯৯ শতাংশই কাঁচা বাড়ি হওয়ায় মৃতের সংখ্যা মাত্র এক। জখম ৪। ক্ষয়ক্ষতি বেশি শহরে। ইম্ফলে চারতলার বেশি উঁচু বাড়ি কমই আছে। এর মধ্যে একটি নির্মীয়মাণ চারতলা বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। গাড়ির উপরে বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনাও বেশ কয়েকটি ঘটেছে। থৌবালের ইয়াইরিপোক বাজারের ১০টি থাম ভেঙেছে। সদর হিলে ভেঙেছে এক বিধায়কের বাড়ি। ইম্ফলের ঐতিহাসিক কাংলা দুর্গের অবশ্য কোনও ক্ষতি হয়নি। ভিতরে গোবিন্দজির মন্দিরও অক্ষত।

বিস্ফোরণ, জঙ্গি-পুলিশ লড়াইয়ের সঙ্গে নিত্য ঘর করেন ইম্ফল তথা মণিপুরের মানুষ। কিন্তু আজকের দিনটা অন্য রকম। এমন ভয় ঢুকেছে মানুষের মনে, যার সমাধান বন্দুকের নলও করতে পারে না। কাংলার পিছনে সূর্য ঢলছে। অন্তত একটা দিনের জন্য নিজেদের মধ্যে না লড়ে মণিপুরে সেনাবাহিনী ও জঙ্গিরা প্রকৃতির হামলার বিরুদ্ধে লড়ছেন। দু’পক্ষের লক্ষ্যই এক, দুর্গতদের উদ্ধার করা।

অন্য বিষয়গুলি:

Earthquake Manipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy