সম্প্রতি জীতু কমল এবং নবনীতা দাসের বিবাহবিচ্ছেদের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
হৃতিক রোশন-সুজান খান, আমির খান-কিরণ রাও, ফারহান আখতার-অধুনা আখতার। এই খ্যাতনামী জুটিদের বিবাহ-বিচ্ছেদের যৌথ বিবৃতির সমাজমাধ্যমে দেখে নড়েচড়ে বসেছিল গোটা দেশ। তারকাদের ঝক্কি বড়। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সারা ক্ষণই কাটাছেঁড়া করছেন কোটি কোটি মানুষ। সম্পর্ক গড়ার সময়ই হোক বা ভাঙার সময়, কোনও কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকে না। তাই তারকারা ইদানীং নিজেরাই কোনও ভাঙনের খবর সমাজমাধ্যমে যৌথ ভাবে জানিয়ে দেন। যাতে উড়ো খবরে রং চড়িয়ে বেশি জলঘোলা না হয়। গত কয়েক বছর ধরে বলিউডে এমনই চল। টলিউড অবশ্য এখনও সেই চলে গা ভাসাতে পারেনি। বিচ্ছেদ, বিশেষ করে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, টলিউডের জুটিরা এখনও ততটা পরিণত হতে পারল না!
সাধারণত তারকারা বিবাহবিচ্ছেদ জানাতে নিজেদের সমাজমাধ্যমকেই বেছে নেন। সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুই ব্যক্তিই যৌথ বিবৃতি দিয়ে সম্পর্কে ইতি টানেন। কিন্তু টলিউডের ক্ষেত্রে সেই খবর অনেক সময়েই কানাঘুষো ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই আবার বিষয়টা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। কারণ কী? নেপথ্যে কি লোক-লৌকিকতা বা সমাজের চোখরাঙানি কাজ করে? অনুসন্ধানে আনন্দবাজার অনলাইন।
বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে যৌথ বিবৃতি কী? এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই একই সঙ্গে তাঁদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে থাকেন। বিবৃতিতে ‘আমি’-র পরিবর্তে ‘আমরা’ বেশি প্রাধান্য পায়। সঙ্গে থাকে ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে দম্পতির যৌথ সিদ্ধান্তের কথা। কয়েক বছর আগে আমির খান এবং কিরণ রাও এই ভাবে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের কথা প্রকাশ্যে এনেছিলেন। দক্ষিণী সুপারস্টার ধনুষ এবং তাঁর স্ত্রী ঐশ্বর্যেরও বিবাহবিচ্ছেদের কথাও একই ভাবে প্রকাশ্যে আসে। তবে ভুল গেলে চলবে না, ধনুষের প্রাক্তন স্ত্রী মেগাস্টার রজনীকান্তের কন্যা। তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে কোনও রকম রাখঢাক করেননি। তালিকায় রয়েছেন চর্চিত দক্ষিণী দম্পতি সামান্থা রুথ প্রভু এবং নাগা চৈতন্য। এই তারকারা প্রকাশ্যে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত জানাতে পারলে, টলিপাড়ায় সমস্যা কোথায়?
সম্প্রতি, অভিনেতা জীতু কমল এবং নবনীতা দাসের বিবাহবিচ্ছেদের খবরে সরগরম হয়েছিল টলিপাড়া। নবনীতা প্রথম ফেসবুকে বিষয়টি জানান। তার পরে জীতু পাল্টা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ‘প্রাক্তন’ স্ত্রীর পাশে থাকার বার্তা দেন। অন্দরের খবর, জীতু জানতেন না, নবনীতা সমাজমাধ্যমে তাঁদের বিচ্ছেদ নিয়ে কোনও রকম বিবৃতি দেবেন। বছর দুই আগে কাঞ্চন মল্লিক এবং তাঁর স্ত্রী পিঙ্কির বিবাহবিচ্ছেদের খবর প্রকাশ্যে আসে। তখনও দু’পক্ষের বাদানুবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায় এবং দেবলীনা দত্তের বিচ্ছেদ নিয়ে এখনও চর্চা চোখে পড়ে। যদিও এখনও তাঁদের আইনি বিচ্ছেদ হয়নি বলেই জানালেন দেবলীনা। বললেন, ‘‘আমরা কিন্তু আর পাঁচটা দম্পতির মতো আলাদা হইনি। আমাদের বিচ্ছেদের ধরন এতটাই আলাদা ছিল যে, অনুরাগীদের আলাদা করে সেটা জানানোর কোনও পরিস্থিতি আমাদের ছিল না।’’ বিবৃতি দেওয়া হোক বা আড়ালেই হোক, যে কোনও বিচ্ছেদই কষ্টের বলে মনে করেন দেবলীনা। কথা প্রসঙ্গেই জানালেন, তথাগতের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ নিয়ে কোনও রকম যৌথ বিবৃতি দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন দেবলীনা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রত্যেকটা বিচ্ছেদের ধরন আলাদা। একে অপরের থেকে আলাদা থাকতে থাকতে ডিভোর্স নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরেই কিন্তু বেশির ভাগ জুটি যৌথ বিবৃতি দেন।’’ বর্তমানে এক ছাদের তলায় থাকছেন না তথাগত-দেবলীনা। তা হলে অদূর ভবিষ্যতে বিবাহবিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়ায় কি হাঁটতে চান দেবলীনা? বললেন, ‘‘এখনও বিষয়টা নিয়ে কিছুই ভাবিনি। তথাগতও ওর তরফে আমাকে কিছু বলেনি। কারণ আমাদের বাচ্চাদের (পোষ্য) সূত্রে আমরা এখনও ভীষণ ভাবেই একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি।’’
টলিউডেও অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। দু’বছর আগে সঙ্গীতশিল্পী অনুপম রায় এবং পিয়া চক্রবর্তী সমাজমাধ্যমে যৌথ বিবৃতি দিয়ে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের কথা জানিয়েছিলেন। আচমকা এই ঘোষণায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন বটে। বিচ্ছেদের কারণ নিয়ে নানা জলঘোলা হলেও, বিচ্ছেদের খবর কখন প্রকাশ্যে আনা হবে, কী ভাবে আনা হবে, সে সবের রাশ সম্পূর্ণ নিজেদের হাতে রেখেছিলেন দু’জনে। অনেকেই ভেবেছিলেন, মায়ানগরীর মতো তা হলে এ বার টলিপাড়াতেও তারকারা হয়তো তাঁদের বিচ্ছেদের খবর জানাতে অনুপম-পিয়ার পথেই হাঁটবেন। কিন্তু তা লক্ষ করা যায়নি। কখনও ঘনিষ্ঠ সূত্রে খবর ফাঁস হয়েছে। কখনও আবার কোনও এক পক্ষ এগিয়ে এসে তাঁর বিচ্ছেদের খবর জানিয়েছেন। আবার কখনও দু’পক্ষের কাদা ছোড়াছুড়িও সমাজমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে। অনুপম অবশ্য এই নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে বাকিদের বিষয়টা আমি জানি না এবং না জেনে এই রকম একটি বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা উচিত হবে না।’’ দু’বছর আগে ছোট পর্দার অভিনেত্রী তিয়াসা রায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তিনিও এই প্রসঙ্গে কোনও রকম মন্তব্য করতে রাজি নন।
টলিউডের তারকারা যে সমাজের ভয়ে যৌথ বিবৃতি দিতে চান না এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হতে পারলেন না মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘প্রত্যেকটি বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ-পূর্ব এবং বিচ্ছেদ-পরবর্তী আখ্যান খুবই আলাদা। বলিউড এবং টলিউডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।’’ বলিউড বা দক্ষিণী তারকাদের ক্ষেত্রে যৌথ বিবৃতির নেপথ্য কারণও টলিউডের থেকে আলাদা বলে মনে করেন অনুত্তমা। বললেন, ‘‘তাঁরা দেশের পাশাপাশি অনেক সময় বিশ্বের কাছেও বহুল চর্চিত নাম। তাঁদের বিয়েটাও অনেক বেশি চর্চায় থাকে। বিচ্ছেদটা যে হেতু আইনি চুক্তির পরিবর্তন, তাই অগণিত অনুরাগীর প্রতি হয়তো বা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই তাঁরা যৌথ বিবৃতি দিয়ে থাকেন। এর ফলে সম্পর্কের অবস্থানগত পরিবর্তন নিয়ে ভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব।’’
কথা প্রসঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন তোলেন অনুত্তমা। তাঁর কথায়, ‘‘সমাজমাধ্যম আসার পর ভীষণ ভাবে চর্চিত সে রকম কোনও যুগলের বিবাহবিচ্ছেদই বা টলিউড ক’টা দেখেছে?’’ বিচ্ছেদের কথা ঘোষণা করাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তির নিজস্ব মানসিকতার উপরেই নির্ভরশীল বলে মনে করেন অনুত্তমা। তাঁর কথায়, ‘‘এ রকমও তো হতে পারে যে বিচ্ছেদ নিয়ে দু’জনে কোনও রকম যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। অথবা বিচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্যে সেই সৌজন্য সংলাপের অবকাশও আছে কি না সেটাও অনেক সময় বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। আগে তো নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া, তার পর তো আসবে ঘোষণার প্রসঙ্গ।’’
প্রায় পাঁচ বছর ধরে আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা লড়েছেন টলিপাড়ার চর্চিত জুটি রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রিয়াঙ্কা সরকার। অবশেষে তাঁরা পুত্র সহজের কথা ভেবে আবার একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাবতীয় মামলাও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। রাহুল বললেন, ‘‘বাঙালিদের মধ্যে এখনও ততটা ফর্ম্যালিটি আসেনি বলেই হয়তো যৌথ বিবৃতির ধারণাটা এখনও স্পষ্ট নয়।’’ এই প্রসঙ্গেই তাঁর সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার বিচ্ছেদের উদাহরণ দিলেন রাহুল। বললেন, ‘‘বিচ্ছেদ এতটাই বেদনাদায়ক যে তার সঙ্গে লড়তে লড়তে কোনও রকম যৌথ বিবৃতি দেওয়ার কথা আমাদের মাথায় আসেনি।’’
বাংলায় তারকাদের বিচ্ছেদে যৌথ বিবৃতি না দেওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ দর্শালেন রাহুল। তাঁর কথায়, ‘‘ছোট ইন্ডাস্ট্রিতে খবর চেপে রাখা কষ্টকর। বিবৃতি দেওয়ার আগেই দেখা যায় সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছে। আমি আর প্রিয়াঙ্কা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় খবরটা প্রকাশ্যে চলে এসেছিল!’’ কথা প্রসঙ্গেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন রাহুল। তাঁর মতে, অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা থাকার সময় সন্তানের সামনে দম্পতিরা এক জন অন্য জনকে ‘খলনায়ক’ করে তোলেন। ফলে ভবিষ্যতে সম্পর্ক জোড়া লাগলেও সন্তান কিন্তু কোনও এক জনের সঙ্গে আর থাকতে চায় না। ফলে সেই সম্পর্ক আবার ভাঙনের মুখে দাঁড়ায়। রাহুল বলেন, ‘‘আলাদা থাকার সময় আমি সহজের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করেছি। কিন্তু ও তো প্রিয়াঙ্কার সঙ্গেই সারা বছর থাকত। প্রিয়াঙ্কা কিন্তু আমাকে ওর কাছে ভিলেন সাব্যস্ত করেনি। সে জন্য আমি প্রিয়াঙ্কার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’’
দেশের আইন কী বলছে? কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী রাজদীপ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘বাঙালি সমাজে এখনও বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে ছুতমার্গ রয়েছে। তারকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, চারপাশের কে কী বলবেন সেই ভাবনাটাই দম্পতিদের বেশি ভাবায়। তাই অনেকেই বিষয়টাকে ব্যক্তিগত রাখতে চান। বলিউড এ ক্ষেত্রে অনেকটাই আধুনিক।’’ দম্পতিদের মধ্যে কারও অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে, বিষয়টি বিচারাধীন থাকে। রাজদীপের মতে, গার্হস্থ্য হিংসা থেকে শুরু করে পরকীয়া সম্পর্ক, এমনকি, যৌন অক্ষমতা— নানা অভিযোগ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার কোনও অবকাশ থাকে না। যেমন অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রোশন সিংহের বিবাহবিচ্ছেদের মামলা এখনও বিচারাধীন। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও মামলার ফয়সালা এখনও হয়নি। আবার নিখিল জৈনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের সময় মামলার জবাবে সেই বিয়েকে আদালতে ‘অবৈধ’ উল্লেখ করেছিলেন অভিনেত্রী নুসরত জাহানের আইনজীবী। ‘মিউচুয়াল’ অর্থাৎ উভয় পক্ষের সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ হলে স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে থাকেন। রাজদীপ বললেন, ‘‘যৌথ বিবৃতি প্রকাশের আগেও কিন্তু দু’পক্ষের আইনজীবীর পরামর্শ নিয়েই তা প্রকাশ্যে আনার সিদ্ধান্ত নেন তারকা দম্পতিরা।’’ সাধারণত যৌথ বিবৃতি প্রকাশের পর নতুন করে দম্পতিরা একে অন্যের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বা মামলা করেন না বলেই জানালেন রাজদীপ।
প্রকাশ্যেই হোক কিংবা আড়ালে, বিচ্ছেদের ঘোষণা যে সম্পর্কে থাকা দু’টি মানুষের ব্যক্তিগত বা কখনও পারস্পরিক সিদ্ধান্তের ফসল, তা এক প্রকার স্পষ্ট। তিক্ত সম্পর্কে দু’টি মানুষের কাছে বিচ্ছেদ যেমন অগ্রাধিকার পায় তাঁদের ভাল থাকার শর্তে, তেমনই সিংহভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু বিচ্ছেদের পথে না হেঁটে ভঙ্গুর সম্পর্কও কখনও কখনও জোড়া লাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy