‘হাওয়া’র মুক্তি উপলক্ষে কলকাতায় এসেছেন ছবির পরিচালক। ছবি: সংগৃহীত।
তাঁর ফোন সুইচ্ড অফ। ঢাকা থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে সোজা চলে এলেন সাংবাদিক সম্মেলনে। মেজবাউর রহমান সুমন। ‘হাওয়া’ ছবির পরিচালক। ছবি মুক্তির আগে একান্তে পাওয়া গেল তাঁকে।
প্রশ্ন: আপনার কি এই প্রথম কলকাতায় আসা?
সুমন: (হেসে) ছোটবেলা থেকে কলকাতায় আসছি। কত বার সেটা গুনেও বলতে পারব না। এখানে প্রচুর বন্ধুবান্ধব রয়েছে। ঢাকার পর কলকাতা হল আমার সবচেয়ে পছন্দের শহর।
প্রশ্ন: কিন্তু নিজের ছবি নিয়ে আসাটা নিশ্চয়ই অন্য রকম অনুভূতি?
সুমন: অবশ্যই। নতুন অভিজ্ঞতা। কারণ ‘হাওয়া’ তৈরির সময় বহু বার কলকাতায় আসতে হয়েছিল। এমনকি, এই ছবি তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গেও কলকাতার বেশ কয়েক জন জড়িয়ে রয়েছেন। রূপটান, কালার কারেকশন এবং সাউন্ড বিভাগে তাঁরা কাজ করেছেন। তাই বলা যায়, দুই বাংলার মানুষই ছবিটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু এ বারের আসাটা সত্যিই আমার কাছে অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে হাজির হয়েছে।
প্রশ্ন: মুক্তির পর বাংলাদেশে ‘হাওয়া’ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ছবিটা ঘিরে কলকাতার দর্শকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস বা এই উন্মাদনা কি শুরুতে আশা করেছিলেন?
সুমন: সত্যি বলছি, ছবিটাকে ঘিরে যে আদৌ মানুষের কোনও আগ্রহ তৈরি হবে শুরুতে সেটাও ভাবিনি। তা ছাড়া দর্শক যে আমার ছবি ঘিরে মারাত্মক উৎসাহ দেখাবেন, সাধারণত এমন কোনও আশা রেখে আমি অন্তত ছবি তৈরি করি না।
প্রশ্ন: সে কী! তা হলে ছবি তৈরির পিছনে আপনার দর্শন কী?
সুমন: (হেসে) আমার মতে, এক জন নির্মাতা হিসেবে আমার চিন্তাভাবনাকেই ছবির মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে চাই। সেটা পারছি কি না, সেটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার পরে দর্শক যদি কাজটা পছন্দ করেন, তা হলে সেটা আমার কাছে বাড়তি প্রাপ্তি। ‘হাওয়া’র সাফল্যকে মাথায় রেখেও পরের ছবিটা তৈরি করতে চাই না।
প্রশ্ন: ছবি মুক্তির আগেই ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গান হিট। কী মাথায় রেখে গানটা বেছেছিলেন?
সুমন: সিনেমার প্রয়োজনেই গানটা রাখা। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন চারুকলা বিভাগের ছাত্র, তখন হাশিম মাহমুদ আমাদের সঙ্গে গানটা গাইতেন। বহু পুরনো গান। মানুষ গানটা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছেন। তাই ছবির মাধ্যমে গানটাকে আর হাশিমভাইকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: কিন্তু ছবিতে ব্যবহৃত গানটি তো ওঁর গাওয়া নয়।
সুমন: কারণ, হাশিমভাই তখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। ইচ্ছে থাকলেও ওঁকে দিয়ে তাই গানটা আমরা রেকর্ড করাতে পারিনি। তাই গানটা গায় আরফান মৃধা শিবলু। মাঝে আমরা হাশিমভাইয়ের চিকিৎসা করিয়েছিলাম। কিন্তু এখনও উনি অসুস্থ।
প্রশ্ন: ছবিতে চঞ্চল চৌধুরী-সহ ছবির বাকি অভিনেতাদের দেখে সত্যিই মনে হয় তাঁরা মৎস্যজীবী। কী ভাবে এটা সম্ভব হল?
সুমন: দু’বছর ধরে আমি আমার ইউনিট নিয়ে সমুদ্রে যেতাম। শিল্পীদেরও নিয়ে যেতাম। সেখানে জেলেদের সঙ্গে থেকে তাঁদের জীবনকে কাছ থেকে দেখে এই ছবির রিসার্চ ওয়ার্ক করা হয়েছে। তার পর ঢাকায় ছ’মাস ধরে ওয়ার্কশপ। ছবির মেকিং নিয়ে আমাদের কিছু ভিডিয়ো আছে। ওগুলো দেখলে এই জার্নিটা মানুষ হয়তো কিছুটা বুঝতে পারবেন।
প্রশ্ন: শুক্রবার কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘হাওয়া’ দেখানো হবে। একই দিনে সিনেমাহলেও ছবিটা মুক্তি পাচ্ছে। এটা কি কাকতালীয়?
সুমন: আসলে ১৬ তারিখ ‘বিজয় দিবস’ উপলক্ষেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ বারে কাঁটাতার পেরিয়ে ছবিটা পশ্চিমবঙ্গে এই বিশেষ দিনে মুক্তি পাচ্ছে— এটা তো বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে শুধু ‘মুক্তি’ নয়, অনেক বড় মুক্তি। অনেক বড় পাওয়া।
প্রশ্ন: কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের একটি আলোচনা সভাতেও তো আপনার যোগ দেওয়ার কথা।
সুমন: শুনেছি। কিন্তু কত দিন কলকাতায় থাকব সেটা ঠিক করিনি। তাই আলোচনা সভায় যোগ দিতে পারব কি না, সেটা এখনই বলতে পারব না। তবে উৎসবে ছবির প্রদর্শনে থাকব।
প্রশ্ন: এ পার বাংলা থেকে আপনার পছন্দের বাঙালি পরিচালক কারা?
সুমন: সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক। মনে আছে, ছোটবেলায় আমার মামা আমাকে প্রথম ‘সোনার কেল্লা’ দেখিয়েছিলেন। কলেজ জীবনে ‘অযান্ত্রিক’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখি। সেই সময়টা থেকেই আমার মাথায় সিনেমা তৈরির ভূত চাপে।
প্রশ্ন: আর এখন?
সুমন: অনেকেই রয়েছেন। সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘হারবার্ট’ খুব পছন্দের ছবি। কবিদার (পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী) সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল। ওঁর ‘ফড়িং’ ছবিটা দেখেছি। আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তর ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ খুব ভাল লেগেছিল।
প্রশ্ন: আপনি তো বাংলাদেশের ওটিটি-তে কাজ করেছেন। শুনেছি আপনার একটা গানের দল আছে।
সুমন: আমার ব্যান্ডের নাম ‘মেঘদল’। এক সময়ে কবিতা লিখতাম। এখন ব্যান্ডে গানও করি। আর ওটিটি-তে ঘন ঘন কাজ করতে চাই না। যখন মনে হবে কিছু বলার প্রয়োজন, তখন না হয় ছবি তৈরি করব।
প্রশ্ন: গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে ছিল বাংলাদেশের ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। এবারে ‘হাওয়া’ নিয়ে উন্মাদনা। তরুণ পরিচালকদের হাতে সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের ছবির দিক পরিবর্তনকে কী ভাবে দেখেন?
সুমন: ইরানের ছবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার একটা বড় কারণ ‘সেন্সরশিপ’। নিষেধাজ্ঞা থাকলে কথা বলা শক্ত। তাই ওঁরা অন্য গল্পের মধ্যে দিয়ে অন্য ভাবে নিজেদের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। ঢাকায় এখন একই অবস্থা। সেখানে ছবি তৈরি খুব কঠিন। সিনেমাহল নেই, প্রযোজক নেই, দর্শক নেই। চারিদিকে শুধু ‘নেই’। তরুণ পরিচালকদের ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই বাংলাদেশে ছবি তৈরি হয়। আমার মতে, অনেক না-থাকা বা না-পাওয়ার মধ্য দিয়েও একটা শক্তি তৈরি হয়, যেটা আমার মতো ঢাকার অসংখ্য তরুণ পরিচালকের মনে ছবি তৈরির উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছে।
প্রশ্ন: একটা সময় বাংলাদেশের ছবি নিয়ে রসিকতা করা হত। এখন আপনাদের ছবি এবং ওয়েব সিরিজকে সমালোচকরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার কী মত?
সুমন: আমার মতে, সিনেমা পরিবর্তনের জন্য একটা প্রজন্মের প্রয়োজন। কলকাতায় সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেটা করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতা কি এখন আছে? আমাদের ওখানেও এই পরিবর্তনটা বিক্ষিপ্ত ভাবে হয়েছে। এখন বাংলাদেশে নতুন নতুন পরিচালকরা নতুন ভাবে ভাবছেন। এই ধারা বজায় থাকলে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের ছবির ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।
প্রশ্ন: ‘হাওয়া’র অস্কারে মনোনয়ন পরিচালক হিসেবে কি কাজের স্বীকৃতি দিল? না কি দায়িত্ব আর ভয় বাড়িয়ে দিল?
সুমন: উত্তরটা একটু অন্য ভাবে দিতে চাই। প্রথম ছবি থেকে কী প্রাপ্তি হল, সেটা আমাকে খুব একটা বিচলিত করে না। একটা কাজ করে থেমে গেলে চলবে না। কারণ, একটা ছবি দিয়ে কাউকে বিচার করা খুব কঠিন। কোনও পরিচালকের ছবি ভাল লাগলে চেষ্টা করি তাঁর অনেকগুলো ছবি দেখে তার পর একটা সিদ্ধান্তে আসতে। শুধু আমার ছবি কেন, বাংলাদেশ বা কলকাতার কোনও ছবি বিশ্বের প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে গেলে সেটা বাঙালি হিসেবে আমাদের কাছে পরম প্রাপ্তি।
প্রশ্ন: পরের ছবির পরিকল্পনা কত দূর?
সুমন: চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে গিয়েছে। লোকেশন দেখার কাজ চলছে। শুটিং শুরু হতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy