‘অনেক ক্যানসার রোগীকে মনোবল জুগিয়েছে ও’, বললেন ঐন্দ্রিলার চিকিৎসক। — ফাইল ছবি।
ফাইটার! লড়াকু! বিশেষণটা ঐন্দ্রিলার জন্য একেবারে ঠিকঠাক। মনের জোরে একটা মানুষ কী ভাবে বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে এনেছে, তার সাক্ষী তো আমিই। কখনও বলতে হয়নি, ‘ফাইট, ঐন্দ্রিলা ফাইট’! প্রায় সাত বছর ধরে ওর চিকিৎসা করেছি। আমার মেয়ের মতোই ছিল। ঐন্দ্রিলার বাবা আমার খুবই কাছের মানুষ। মেয়েটার লড়াই করার ইচ্ছেকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
ঐন্দ্রিলার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার। এমনকি, চিকিৎসকদেরও। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ক্যানসার হলে অনেকে গোপন করতে চান। ও কিন্তু সেই পথে হাঁটেইনি। কেমোথেরাপির নেওয়ার পর চুল উঠে গিয়েছে। কোনও দিন পরচুল পরেনি। ও ভাবেই প্রকাশ্যে এসেছে। অভিনয় করে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করেছিল বোধহয়! ওই যে, ‘ভাল মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে’। প্রতি বার সেই সত্যিটাকে নিয়েই ও লড়ে গিয়েছে। জয়ী হয়েছে। আবার হেরেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে নিয়ে এ ভাবেই লড়ে গিয়েছে জীবনের মাঠে।
মনে পড়ছে, ২০১৫ সালে দিল্লির এমসে গিয়েছিল ঐন্দ্রিলা। ‘সফ্ট টিস্যু সারকোমা’র চিকিৎসা নিয়ে আর এক প্রস্ত মতামত নেওয়ার জন্য। সেখানে থেকেই সোজা আমার কাছে। এখানেই ওর চিকিৎসা শুরু হয়। কেমোথেরাপির পর রেডিয়োথেরাপি। কয়েকটি কেমো ও বহরমপুরে নিজের বাড়িতেও নিয়েছিল।
তখনও ঐন্দ্রিলা অভিনেত্রী হয়নি। হতে চাইত। স্কুলে পড়ে। দারুণ জেদ। এই সময়টায় ওর চিকিৎসা কিন্তু এ রাজ্যের একটি জেলা হাসপাতালেও হয়। এর পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে ও। আবার ডুবে যায় নিজের কাজে। অভিনয় শুরু করে। একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। কিন্তু যখনই স্বাভাবিক জীবনের পথে একটু এগিয়েছে, তখনই ফিরে এসেছে ক্যানসার।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ছ’বছর পর দ্বিতীয় বার ক্যানসার ফেরত এল ওর শরীরে। দ্বিতীয় বার, কারণ এক বার ক্যানসার সেরে গিয়ে পাঁচ বছর পর ফিরলে সেটাকে ‘দ্বিতীয়’ হিসাবে ধরা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে। যখন ভেবেছি, ও সুস্থ, তখনই ফের এল সেই রোগ! দিল্লিতে আবারও যায়। আর একপ্রস্ত মতামত নিতে। সেই সময়টায় একটু ভেঙে পড়ে। তবে লড়াইটা ছাড়েনি। লড়াকু তো!
দ্বিতীয় বারের ক্যানসারে ফুসফুসে জটিল একটা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। ওটা এতটাই জটিল ছিল যে, ঐন্দ্রিলা অপারেশন থিয়েটারের টেবিলেই মারা যেতে পারত। অস্ত্রোপচারের আগে সে কথা খোলাখুলি বলেছিলাম। মৃত্যু হতে পারে, সে কথাও! তবে ও এ সবে কান দেয়নি। এক মুহূর্ত না ভেবে বলেছিল, ‘‘আপনি ওটি করুন।!’’ সেই জটিল অস্ত্রোপচারও সফল হয়। লড়াই করেই জিতেছিল।
অসম্ভব ‘পজিটিভ’ ভাবনার একটি মেয়ে ছিল ঐন্দ্রিলা। একা ও নয়, ওর পরিবারও। ক্যানসার রোগীর মানসিক পরিস্থিতির উপরেই নির্ভর করে তাঁর সুস্থতার সম্ভাবনা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ক্যানসারের কারণে নয়, মানসিক জোর হারিয়ে ফেলেছেন বলেই অনেক রোগী মারা যান। অনেক সময় অন্য শারীরিক অসুস্থতার কারণেও মৃত্যু হয়। এ-ও দেখেছি, সেই ক্যানসার রোগী ভাল রয়েছেন। অথচ যে মানুষটি তাঁর চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছেন, তিনি চলে গিয়েছেন। ঐন্দ্রিলার মতোই মনের জোর ছিল ওর পরিবার আর বন্ধুবান্ধবের। তাঁরাও সমান ভাবে লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ওকে প্রাণশক্তি জুগিয়েছিলেন।
শেষ বার ঐন্দ্রিলার ব্রেনে ব্লিডিং হল। দুর্ভাগ্যজনক! আমরা অস্ত্রোপচার করে রক্ত বার করলাম। সত্যি বলতে কি, আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তার পরেও রক্ত বার করা হয়। ও কিন্তু লড়াইটা চালিয়েই যাচ্ছিল। স্ট্রোক হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। ২০ দিন ধরে সাংঘাতিক লড়াই করেছে মেয়েটা। কখনও চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছে। একটু ভাল হয়েছে। আবার অবনতি!
আমরা চিকিৎসকেরা জানি, রোগী যদি ‘পজিটিভ’ ভাবনায় থাকেন তা হলে তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ওর মধ্যে সেই ‘পজিটিভ’ মানসিকতা ছিল। তাই ও ‘ট্রু স্টার’। ও ‘ট্রু ফাইটার’ও। কিন্তু পর পর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। স্ট্রোক। তাতেই কাহিল হয়ে পড়ল মেয়েটা। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণেই চলে গেল। যার কারণ ক্যানসারও হতে পারে।
তরুণ বয়সে অনেকের ব্রেনের ভেসেল ভঙ্গুর থাকে। সম্ভাবনা থাকে রক্তক্ষরণের। ঐন্দ্রিলার সম্ভবত সেটা হয়েছিল ক্যানসারের কারণেই। ২০ দিনে জ্ঞান ফিরেছিল। তবে কথা বলার অবস্থায় ছিল না। কারণ মুখে পাইপ ছিল যে! তবে ওর শরীর সাড়াও দিচ্ছিল বার বার।
বেশ কয়েক বছরের ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা থেকে আমি জানতাম, ছোটবেলা থেকেই ও লড়াকু। সেটাই প্রতি দিন দেখতাম চোখের সামনে। একা একা লড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। আমি চিকিৎসক হিসাবে ওকে সরবরাহ করে যাচ্ছি একের পর অস্ত্র। যাতে এই লড়াইটা জিততে পারে। আশ্চর্য লাগে ভেবে, ঐন্দ্রিলা এই লড়াইটা লড়তে গিয়ে কিন্তু রোগযন্ত্রণার মাঝেও ভোলেনি যে, ও অভিনেত্রী হতে চায়! তারকা হতে চায়। শরীরে যা হচ্ছে, হয়ে যাক। চুল উঠে যাচ্ছে। যাক! লুকিয়ে ফেলেনি নিজেকে। ওই অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়েছে। বাকি ক্যানসার রোগীদের উদ্বুদ্ধ করেছে। যাঁরা মনোবল হারিয়ে ফেলতেন, তাঁদের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে রোজ চাগিয়ে তুলত।
যা হতে চেয়েছিল ঐন্দ্রিলা, তাই হয়েছে। তৃতীয় বার রক্তক্ষরণ হয়। বায়োপ্সি রিপোর্টে দেখা যায়, ক্যানসার কোষ বাড়ছে। প্রত্যেক বার এমন পরিস্থিতিতে ও মনে করত, ভাল হয়ে যাবে। কারণ, ও বেঁচে থাকায় বিশ্বাস করত। এটাই ওকে বাঁচিয়ে দিত বার বার।
২০১৫ থেকে ২০২২— বছরের হিসাবে হয়তো সাত বছর ঐন্দ্রিলার চিকিৎসা করেছি। বিশ্বাস করেছি ও আরও বহু বছর বেঁচে থাকবে। আসলে ও-ই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে, বেঁচে থাকতে সাত সমুদ্র তেরো নদীর বাধা পেরোনোর মন্ত্র একটাই— লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের ময়দানে কখনও না কখনও, কোনও না কোনও ‘ফাইটার’কে থামতে তো হয়ই!
(লেখক একটি বেসরকারি হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy