অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল ছবির দৃশ্য।
স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই, মনটা অনেক দিন উপোসি ছিল। বলিউড কত দিন আর আগের মতো হাপুসহুপুস ভালবাসার গল্প বলে না! ইস্যুনির্ভর প্লট আর বায়োপিকের ভরা জোয়ারে সেই চকোলেট-চকোলেট মেলোড্রামা কোথায় গেল! হেসেকেঁদে রুমাল ভিজিয়ে হল থেকে বেরোনো...তেমনটি কি আর পাব না? জেন ওয়াই কি সব বোকা বোকা বলে বাতিল করে দেবে? কর্ণ জোহর কি ভিলেনের পার্ট করেই কেরিয়ারের বাকিটা কাটিয়ে দেবেন?
এই সব গূঢ় জীবন জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে গুমরে মরছিল! ভেবেছিলুম ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ এসে খরাটা কাটাবে! মাঝমধ্যিখান থেকে দেশভক্তির ঠিকাদারেররা চোখ রাঙিয়ে কর্ণকেও ইস্যু বানিয়ে দিল! ছবি দেখতে গিয়ে দেখি, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ আর ‘কাল হো না হো’ ঘাবড়ে গিয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছে। পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে ‘তামাশা’!
মাপ করবেন, আমি মস্করা করতে চাইনি। আবার চেয়েওছি। কারণ কর্ণ নিজেই ছবির অনেকটা অংশ জুড়ে বলিউডকে নিয়ে দিব্যি মস্করা করেছেন। তাঁর নিজের ‘কুছ কুছ...’, ‘মাই নেম ইজ খান’ আর ‘কাল হো না হো’-ও সেই মস্করা থেকে বাদ যায়নি। ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’-য়ে ‘কুছ কুছ...’, ‘কাল হো না হো’, ‘তামাশা’র অনেক উপাদানই মজুত। তার সবটা কীসে কী, বলে দিলে ছবিটা দেখার মজা নষ্ট হবে। এটুকুই বলা ভাল, লন্ডনের এক নাইটক্লাবে রণবীরের সঙ্গে অনুষ্কার মোলাকাত। রণবীরের প্রেমিকাটি এই আছি এই নেই মোডে রয়েছেন। রণবীর তাই নিয়ে মুহ্যমান। অনুষ্কা একটা সিরিয়াস ব্রেক-আপ হজম করে পেয়ার-মহব্বতের আতুপুতু থেকে অনেকটা মুক্ত। সে রণবীরকে খানিক মানুষ করে দেয়, আবার রণবীরের বন্ধুত্বটা চুটিয়ে উপভোগও করে। রণবীর প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু অনুষ্কা বন্ধুত্বের স্বাচ্ছন্দ্যটুকু ছাড়তে রাজি নন। তাঁর মন পড়ে আছে আলির (ফাওয়াদের) কাছে। আবার জখমি ‘দিল’ নিয়ে রণবীর যখন ঐশ্বর্যার কাছে গেলেন, বুঝতেই পারলেন না তার কতটা নিখাদ আকর্ষণ আর কতটা স্রেফ অনুষ্কাকে জবাব দেওয়ার তাগিদ!
‘কুছ কুছ’-এ কর্ণ প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, পেয়ার দোস্তি হ্যায়। কিন্তু সেখানে শাহরুখকে কাজলের কাছে ফেরানোর জন্য রানিকে মরতে হয়েছিল। আবার ‘কাল হো না হো’-তে নিজে মরে প্রীতি আর সেফকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন শাহরুখ। সুতরাং পেয়ার আর দোস্তিকে কোনও বারই সেই অর্থে খুব দীর্ঘমেয়াদি ডুয়েল লড়তে হয়নি। অল্প যেটুকু সময় তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, পেয়ারের কাছে পরাস্ত হয়েছে দোস্তি। ‘অ্যায় দিল’-এর মজাটা এই যে, এখানে পেয়ার আর দোস্তি তাদের যাবতীয় ঠোকাঠুকি নিয়ে সমান্তরালই থেকে যায়। অনুষ্কা তাঁর দোস্তির সীমানা ছাড়েন না, রণবীর ছাড়তে পারেন না তাঁর পেয়ার। শুধু জীবন ঘাড় ধরে শিখিয়ে দেয় — কার কাছে কোনটা জুনুন, কোনটা সুকুন, কোনটা জরুরত আর কোনটা খোয়াইশ, তাই নিয়ে মাথা খারাপ করার চেয়েও বড় সত্য একটা আছে। সান্নিধ্যের ওমটুকু সেই সত্য। সমস্ত নামকরণ, সমস্ত শব্দজব্দ তার কাছে বেকার।
আজ্ঞে হ্যাঁ। ‘কুছ কুছ’-এর আঠেরো বছর হল, কর্ণ জোহরের বয়সও কিঞ্চিত বেড়েছে। জীবনের বেশ খানিকটা রাস্তা তাঁরও হেঁটে আসা হয়ে গেল।
সমস্যা একটাই। পরিণত মনের সঙ্গে খানিকটা পরিমিতি বোধও এলে ভাল হতো। সে গুড়ে বালি! কর্ণের ছবিতে অনন্ত বিদেশি লোকেশন থাকবে না, ডিজাইনার জামাকাপড়ের মেলা বসবে না, চোখ ধাঁধানো ঘরবাড়ি থাকবে না, নায়ক-নায়িকারা জীবনে নাচা-গাওয়া-খাওয়াদাওয়া করেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে না, প্রতিটি ফ্রেম ওয়ালপেপারের মতো বর্ণিল আর সিন্থেটিক হবে না — নাঃ এ সব কেউ আশা করছে না। কিন্তু যে গল্পটা বলতে বসেছেন, সেটাকে তো শক্ত করে বাঁধতে হবে! সব কিছু খুব বেশি করে বলতে গিয়ে, অতি বিস্তার করতে গিয়ে কর্ণ নিজেই মুশকিল বাধিয়ে বসে আছেন। যেখানে সংক্ষেপ দরকার ছিল, সেগুলো ইয়া লম্বা হয়ে গেছে। যেখানে মন আরও বেশি চাইছিল, সেগুলো পুঁচকে থেকে গেছে।
যেমন ধরা যাক, চোখা সংলাপ আর উইট-য়ের চিমটি কর্ণর ছবির একটা ইউএসপি। কিন্তু তাই বলে এত? মাঝে মাঝে মনে হতে পারে, ছবির চরিত্ররা বুঝি স্বাভাবিক চলনে কথাই বলতে পারে না! আদ্দেক সময় তারা দম নেওয়ারই সময় পায় না। তাহলে দর্শকের অবস্থা বুঝুন। উপভোগ করতেও তো সময় লাগে। সেই ফাঁকটুকু তো তাকে দিতে হবে। এক-একটা ভারী দৃশ্য শেষ হতে না হতেই যদি ক্রমাগত তারস্বরে মিউজিক ছুটে আসতে থাকে, তা হলে তৈরি হওয়া আবেগটা মনের মধ্যে সেঁধোবে কখন? আর একই জিনিস অতিমাত্রায় ব্যবহার করলে একঘেয়ে মনে হবেই, আগে থেকে আন্দাজও করা যাবে!
অথচ কলাকুশলীরা কিন্তু মন্দ কেউ না। প্রীতমের সুরে ‘চান্না মেরেয়া’, ‘বুলেয়া’ আর টাইটল সং তো ইতিমধ্যেই সুপারহিট। রণবীর আর অভিনয় নিয়েও কোনও কথা হবে না। খুবই ভাল। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক, কেউই এই ধাঁচের চরিত্র একেবারে প্রথম করছেন না। আর কান্না-কান্না ছেলের সঙ্গে রাফ-টাফ মেয়ের গল্পটাও এ বারে একটু ক্লিশে লাগতে শুরু করেছে। কর্ণের ছবিতে নায়িকাদের এমনিতেই বাড়তি গ্ল্যামারাস দেখায়। সেখানে ঐশ্বর্যাকে তাঁর সেই পুরনো রূপের ছটায় ফিরে পেয়ে কর্ণ সেটা হাত উপুড় করে ব্যবহার করেছেন। রণবীরের সঙ্গে ঐশ্বর্যার নিবিড় রসায়ন নিয়ে অকারণে চর্চা হচ্ছে না। কিন্তু এটাও বলব, ঐশ্বর্যার গ্ল্যামারকে বেশি করে পুঁজি করতে গিয়ে কর্ণ ওই চরিত্রটার গাঁথুনিতে যথেষ্ট মন দেননি। কবি ঐশ্বর্যার মনের ভেতরটা, স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্কের সমস্যার দিকটা তেমন করে আলো ফেলেননি। একতরফা প্রেমের তাকত কী হতে পারে, সেটা বলতে গিয়ে এখনও শাহরুখ খানকেই ডেকে আনতে হচ্ছে বটে! কিন্তু আনলেনই যখন, তখন শাহরুখের সঙ্গে ঐশ্বর্যার একটা মজবুত দৃশ্য রাখা দরকার ছিল। রণবীর-অনুষ্কা-ঐশ্বর্যার দৃশ্যটা যে রকম জমল, সেটা কিন্তু শাহরুখ-রণবীর-ঐশ্বর্যার ক্ষেত্রে ঘটল না।
যাঁকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ফাওয়াদ খানই বা ছবিতে কতটুকু! তাঁকে বেশ কয়েক বার দেখা যায় শুধু, তাঁর চরিত্রটা বিশদে লেখা হয় না। তবে ফাওয়াদ এত অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর, যে তিনি পর্দায় থাকলেই পয়সা উসুল। দাড়িতে তাঁর রূপ আরও যেন খুলেছে। আর যেহেতু ফাওয়াদ অভিনয়টাও করেন চমৎকার, দ্বিতীয়ার্ধে রণবীর-অনুষ্কার অংশ খানিক কমিয়ে ফাওয়াদ আর অনুষ্কার গল্পটা ভেঙে দেখালে ছবিটা অনেক ভাল হতে পারত। ব্যর্থ মেলোড্রামার অসুখবিসুখে ভুগতে হতো না। ঐশ্বর্যা পর্বটা শেষ হওয়া ইস্তকই ছবিটা কিন্তু মিইয়ে যায়। সব মিলিয়ে এক লাইনে বলতে গেলে, যদি ‘কুছ কুছ...’ বা ‘কাল হো না হো...’ ইত্যাদি মাথায় রাখি, অ্যায় দিল... অনেক পিছিয়ে। কিন্তু যদি মাপকাঠি ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ হয়, তা হলে ‘অ্যায় দিল’ অমৃত না হোক পোলাও-কালিয়া তো বটেই!
আর একটা কথাও এই বাজারে আলাদা করে বলা উচিত। এই ছবিতে রণবীরের নাম আয়ান, অনুষ্কার নাম আলিজে, ঐশ্বর্যা শাবা। রাজ-রাধা-পূজা যেমন হয় তেমনই। এমনি এমনি। যে মুহূর্তে এই কথাটা আলাদা করে লিখলাম, ওই এমনি এমনি-র মাধুর্য, সহজতা একটু হলেও নষ্ট হল। বাড়তি নজরটান এসে পড়ল। তবু লিখলাম। কারণ যা দিনের আলোর মতো, নিশ্চিন্ত ঘুমের মতো সহজ হওয়ারই কথা ছিল, সেটা আমরা সহজ রাখতে পারিনি। কেউ সেই সহজতার পলতেটা উস্কে দিতে চাইছেন দেখলে, ধন্যবাদ না জানিয়ে থাকি কী করে! আশা করব, দীপান্বিতার এই মরসুম কর্ণের অন্তরাত্মা থেকে মুচলেকার অমাবস্যাটুকু ঘুচিয়ে দেবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy