প্রতীকী চিত্র
ছোট থেকে আজ পর্যন্ত রাজনীতি এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু দেখেছি। কংগ্রেস সরকারের পতন দেখেছি, সাতের দশকে বোমাবাজি দেখেছি, ২০১১ সালে তুলকালাম পরিবর্তন দেখেছি। এ সব কিছুর সঙ্গে সঙ্গে এটাও দেখেছি, কী ভাবে মূল্যবোধটা পড়ে গেল, কী ভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেল ভয় পেয়ে পেয়ে।
ছোটবেলায় ভোট মানেই ছিল উৎসব। বাড়িতে ভাল ভাল খাবার রান্না হচ্ছে। পাড়ায় বড়দের আড্ডা বসেছে। আমার বাড়ির সবাই ছিলেন কংগ্রেস-পন্থী। একমাত্র বাবা ছিল কমিউনিস্ট। ভোটের সময় মা’কে নিয়ে টানাটানি হত। মা কোন দিকে ভোট দেবে? বাবা বলত, তাঁর দলকে ভোট দিতে। মা বলত, ‘‘ডাকলে তো সোমেন মিত্রই আসেন। তোমার দলের কেউ আসেন? তা হলে কংগ্রেসকেই ভোট দেব।’’ ব্যস, দূর থেকে শোনা যেত ছোড়দাদুর গলা। ‘‘মিনতি একদম ঠিক বলেছে! কংগ্রেসকেই ভোটটা দেবে।’’ পাড়ার বড়রাও বাবার পিছনে লাগার জন্য বলতেন, ‘‘এ বার কাস্তেটা হড়কে হাতে চলে আসবে নাকি!’’ এই পর্যন্তই। কোনও কাদা ছোড়া নেই, বোমাবাজি নেই। এ রকম উৎসবের মেজাজ নিয়েই ভোটপর্বের সকালটা কেটে যেত। বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে ওই ছোড়দাদুই বাবাকে বলতেন, ‘‘অনেকে হয়েছে। এ বার খেতে বোস। অনেক কমিউনিস্ট হয়েছিস!’’
তা বলে কি ওঁরা রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন? মোটেই না। বাবার কাছে কমিউনিজমের ইতিহাস জেনেছি। বাড়ির অন্যদের থেকে কংগ্রেসের ইতিহাস। এ ভাবেই তো চলে। এক প্রজন্ম তার পরের প্রজন্মকে বলে যায় নিজের সময়ের সমাজ, রাজনীতির ইতিহাস। আমার পরের প্রজন্মকে আমি কী বলে যাব? মাঝে মাঝে ভাবলে মনে হয়, শুধু দুর্নীতির ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই বলার নেই।
এক সময় নিজেও সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তার পরে সেই দল থেকে সরেও এসেছি। অপারেশন বর্গার গাজর ঝুলিয়ে রেখে ৩৪ বছরের বেশি শাসন করা যেত না। শুধু একা আমি সরে এসেছি, এমনটা তো নয়। সাধারণ মানুষ সরে এসেছেন। এখন কলকাতা, রাজ্যের বহু জায়গায় বিদ্যুৎ, জল পৌঁছেছে। আগে ছিল না। এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
সেই ছোটবেলার পর ক্রমে ক্রমে ভোটের ছবিটাও বদলাতে শুরু করল। একটা সময় মানুষকে কোনও ‘পার্টির হতে হত না’। ক্রমশ তাই হল। প্রত্যেককেই কোনও না কোনও ‘পার্টির হতে হল’। মানুষের চোখে রাজনীতি নিয়ে এল ভয়। সেটাই আজ নতুন প্রজন্মকে রাজনীতি থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার মেয়ে রাজনীতিতে উৎসাহী নয়। আমারও ইচ্ছে কমে এসেছে। বরং সাধারণ মানুষের জন্য কাজ, সমাজসেবামূলক কাজ করতে এখন অনেক বেশি ভাল লাগে।
এখন একটা প্রশ্ন বার বার করতে ইচ্ছে করে, আমরা কি অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছি? এই যে এত জন কৃষক মারা গেলেন, আমরা নিশ্চুপ। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের উপর অত্যাচার হল, আমরা নিশ্চুপ। আমাদের সন্তানরা যদি জিজ্ঞাসা করে, আমরা তাদের একটা নিরাপদ দেশ দিয়ে যেতে পারব কি না, তখনও আমরা কি নিশ্চুপই থাকব?
অনেকেই রাজনীতিতে যাচ্ছেন। লাভটা কী হচ্ছে? সকলের যেন একটাই দাবি, ‘আমি তোমার দলে যাচ্ছি, আমায় ভোটে দাঁড় করিয়ে দাও’। অথচ, তাঁদের অনেকেই রাজনীতির ‘র’টুকুও বোঝেন না।
এ ভাবেই বদলে গেল রাজনীতির ছবিটা, ভোটের ছবিটা। নতুন অনেক কিছু এল। দলাদলি এল, স্বার্থ এল, ভয় এল। আর মজাটা চলে গেল।
(লেখক চলচ্চিত্র পরিচালক এবং অভিনেতা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy