দেওয়াল লিখনে, ধানজমিতে খুঁটিতে লাগানো ফ্লেক্সে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম ও ছবি। এমনকী পুকুরেও খুঁটি পুঁতে লাগানো তাঁর নামাঙ্কিত ফ্লেক্স।
কিন্তু কোথায় তিনি?
সশরীরে তিনি হাজির ইসলামপুরে। আমতা-মুন্সিরহাট রোড ধরে বড়সড় মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছেন। পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, পায়ে সাদা স্নিকার। সকাল সাড়ে ১০টাতেই কুলকুল করে ঘামছেন তিনি। মাঝে মাঝে রুমালে মুখ মুছে নিয়েই দু’হাত তুলে অভিবাদন নিচ্ছেন পথচারী, দোকানদারদের। কেউ পাল্টা হাত তুলছেন। কারও আবার কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই। তবুও অক্লান্ত পাঁচলার বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক তথা এ বারের প্রার্থী গুলশন মল্লিক। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘‘রোজ সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর পর্যন্ত পদযাত্রা করছি। বিকেলে জনসভা। মানুষ যে ভাবে সাড়া দিচ্ছেন, আশা করছি ৫০ হাজারে লিড দেব।’’ কথায়, শরীরের ভাষায় ফুটে উঠল আত্মবিশ্বাস।
পাঁচলার রাজনীতিতে ষথেষ্ট পুরনো মুখ গুলশন। এক সময়ে কংগ্রেস করতেন। প্রথম বিধানসভা ভোটে দাঁড়ান ১৯৯৬ সালে। জেতেনও। পরবর্তীতে যোগ তৃণমূলে। তবে ২০০১ সালে তৃণমূলের টিকিট পাননি। এনসিপি-র হয়ে ভোটে দাঁড়ান। শুধু ব্যক্তি পরিচিতির জোরে ২৫ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। তার পর থেকে বরাবরই তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন। ২০১১ সালে ফরওয়ার্ড ব্লককে হারিয়ে বিধায়ক হন। তাঁর দাবি, গত পাঁচ বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাজ করেছেন। প্রচারে তুলে ধরছেন সেই সাফল্যের তথ্য।
কিন্তু বিধায়ক তহবিলের কোটা তো বছরে মাত্র ৬০ লক্ষ। অর্থাৎ পাঁচ বছরে তিন কোটি। তা হলে ২০০ কোটি টাকার কাজ করলেন কী ভাবে? গুলশনের উত্তর, ‘‘বিভিন্ন দফতর থেকে তদ্বির করে টাকা এনে উন্নয়নের কাজ করিয়েছি। তার সুফল পাবই।’’
উন্নয়ন কী সত্যিই হয়েছে?
উত্তর এল বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের ডলি রায়ের কাছ থেকে। উত্তর পাঁচলায় লোকলস্কর নিয়ে প্রচার করছিলেন ফব প্রার্থী। প্রাক্তন বিধায়ক হওয়ার সুবাদে পরিচিত রয়েছে ভালই। সেই সূত্রেই ঢুকে পড়ছিলেন গেরস্থের রান্নাঘরে। প্রার্থীকে সামনে পেয়ে গৃহবধূ গীতা কর্মকার উগরে দিলেন একরাশ ক্ষোভ, ‘‘আমার স্বামী দিনমজুর। ছোট্ট টালির ঘরে বাস করি। বাড়ি করার ক্ষমতা নেই। সরকার থেকে আমার কী বাড়ি করে দেওয়া যায় না?’’ ৭০ বছরের প্রবীণা দীপা কর্মকারের ক্ষোভ, ‘‘আমার প্রতিবন্ধী ভাইপোর বয়স পঞ্চাশ। এখনও প্রতিবন্ধী কার্ড পেল না।’’ বিভিন্ন বাড়ি থেকে অভিযোগ এল, তাঁদের মহল্লায় বাড়ি বাড়ি পানীয় জলের সংযোগ নেই।
তাঁদের আশ্বাস দিয়েই প্রতিবেদকের দিকে তাকিয়ে জোটপ্রার্থী বলে ওঠেন, ‘‘দেখলেন তো উন্নয়নের ছটা। অথচ বিধায়ক ২০০ কোটি টাকার উন্নয়নের গল্প শোনাচ্ছেন! উন্নয়ন হলে এইসব মানুষগুলি তার ছোঁওয়া পেলেন না?’’ একটু থেমে ফের জানালেন, ‘‘কাজ কিছু হয়েছে। কিন্তু চুরিও হয়েছে অনেক টাকা।’’
তা হলে স্বীকার করছেন উন্নয়ন হয়েছে। ডলিদেবীর উত্তর, ‘‘বাম আমলে এত টাকা বরাদ্দ ছিল না। পরে বরাদ্দ বেড়েছে। তাতে বিধায়কের কৃতিত্ব কোথায়?’’ জোটপ্রার্থীর এ সব কথাকে ধর্তব্যেই আনলেন না গুলশন। বললেন, ‘‘২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত উনি বিধায়ক ছিলেন। কোনও কাজ করেননি। এখন হিংসায় এ সব বলছেন। উনি যে সব রাস্তায় প্রচার করছেন সেগুলি যে আমাদের আমলে করা তা নিশ্চয় ওঁকে মনে করাতে হবে না।’’
উন্নয়ন নিয়ে দুই প্রার্থীর চাপানউতোর চললেও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল কিন্তু গুলশনের পক্ষেই। লোকসভায় এই কেন্দ্রে তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৮৬,৬৮১টি। বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৪৯,৭২০ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছিল ৭২২৮ ভোট। কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের ভোট এক হলেও বেশ এগিয়েই রয়েছে তৃণমূল।
তবে এটাই শেষ কথা নয়। কারণ পরিস্থিতি যে ২০১১-র মতো নয়, গত ছয় মাসে তা মালুম পেয়েছেন গুলশন। ইতিমধ্যে চার বার তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে দলের অন্দরে। এমনকী তাঁকে যাতে প্রার্থী না করা হয় সে জন্য বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর কর্মী-সমর্থকেরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। রাস্তা অবরোধ পর্যন্ত করেছেন। খোদ দলনেত্রীর কাছেও পৌঁছে যায় সেই বার্তা। যায় লিখিত আবেদন। কিন্তু ফল হয় উল্টো। দলবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে পোলগুস্তিয়ার পঞ্চায়েত প্রধান নয়নতারা সেখ এবং পাঁচলা যুব তৃণমূল সভাপতি তথা জেলা পরিষদ সদস্য হাফিজুর রহমান দল থেকে বহিষ্কৃত হন। ফলে সংগঠনে তার আঁচ লেগেছে। যদিও পোলগুস্তিয়ায় কংগ্রেস নেতা শরিফুল ইসলাম, পাঁচলার বিজেপি নেতা মোহিত ঘাঁটির তৃণমূলে যোগদানে সেই আঁচ কিছুটা সামাল দেওয়া গিয়েছে বলে স্থানীয় তৃণমূলের দাবি। তবুও যোগ-বিয়োগের খেলায় ধারে ও ভারে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিয়োগের পাল্লাই বেশি ঝুঁকে রয়েছে বলে মনে করছে স্থানীয় রাজনৈতিক মহল।
বহিষ্কৃত হাফিজুর বলছেন, ‘‘দলবিরোধী কোনও কাজ করিনি। বিধায়কের নেতৃত্বে যে দালালরাজ চলছে তার বিরোধিতা করেছি।’’ দুই নেতাকে বহিষ্কার করলেও ক্ষোভ যে দলে থেকেই গিয়েছে তার প্রমাণ, বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর এক নেতা বলেন, ‘‘দলের মধ্যে বয়ে যাওয়া চোরা স্রোত অনেক হিসাব পাল্টে দিতে পারে।’’ এ সব নিয়ে ভাবতে নারাজ গুলশন মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে জানালেন, ‘‘দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভাল।’’ যা শুনে দলের একাংশ বলছেন, ‘‘তা ঠিক। তবে গোয়ালই যদি না থাকে!’’
সারদা, নারদ স্টিং, বিবেকানন্দ সেতু নিয়ে বেকায়দায় পড়া তৃণমূলে হয়ে ভোটের ময়দানে গুলশন শুধু উন্নয়নের ঢাক বাজিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কাঁটা তুলতে পারেন কি না সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy