Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

দলের নেতা হয়েও কড়ি গুনে প্রচারে

টলিউডের তারকা হলেও তাঁরা কেউ দিদির দলের সাংসদ, কেউ বিধায়ক, কেউ বা গালভরা পদাধিকারী। ভোটের মরসুমে তাঁরা চষে বেড়িয়েছেন গোটা রাজ্য। তৃণমূলের হয়ে প্রচার করেছেন সভায় সভায়। সেটাই স্বাভাবিক।

শঙ্খদীপ দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০৪:৩৫
Share: Save:

টলিউডের তারকা হলেও তাঁরা কেউ দিদির দলের সাংসদ, কেউ বিধায়ক, কেউ বা গালভরা পদাধিকারী। ভোটের মরসুমে তাঁরা চষে বেড়িয়েছেন গোটা রাজ্য। তৃণমূলের হয়ে প্রচার করেছেন সভায় সভায়। সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু ব্যাকস্টেজে যে অন্য ছবি! সেখানে দলের জার্সি খুলে ফেলে তিনি পেশাদার শিল্পী। কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিচ্ছেন ‘অ্যাপিয়ারেন্স ফি’। যার পরিমাণ বিশ হাজার থেকে দু’লক্ষ। টলি দুনিয়ায় যে শিল্পীর যত কদর, ভোটবাজারে তাঁর দরও তত। ঝোপ বুঝে কোপ মারার ঘটনাও কম নেই। অবশ্য রুপোলি পর্দা থেকে দিদির দলে আসা সব শিল্পীই যে প্রচারে গিয়ে টাকা নিয়েছেন এমন নয়। কিন্তু টাকা নেওয়া অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংখ্যাই বেশি, জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

ফ্ল্যাশ ব্যাকে মনে পড়ে যেতে পারে হালফিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও-র কথা। তাতে দেখা গিয়েছিল, কোনও এক গ্রামে নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়। জনতার উদ্দেশে বলছেন, ‘‘আমাকে দেখতে হলে আগে পয়সা দিয়ে টিকিট কাটতে হতো। এখন বিনে পয়সায় দেখতে পাচ্ছেন। এ রকমই বিনে পয়সায় দেখতে হলে তৃণমূলকে ভোট দেবেন কিন্তু। নইলে ফের টিকিট কেটে দেখতে হবে!’’

আমজনতাকে পয়সা দিতে না-হলেও টলিউডের শিল্পীদের দেখানোর মাসুল হিসেবে শাসক দলকে যে টাকা গুনে দিতে হয়েছে, সেই খবরটা জানা গেল মঙ্গলবার। রাগে গজগজ করতে করতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক তৃণমূল প্রার্থী এক অভিনেত্রী (যিনি নিজেই এ বার বিধানসভা ভোটে প্রার্থী) সম্পর্কে বললেন, ‘‘ওঁকে জেতাতে আমরা প্রাণপাত করছি। আর উনি আমাদের প্রচারে এসে টাকা নিচ্ছেন।’’

ভোট প্রচারে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। আশির দশকের শেষ থেকেই এই চলের শুরু। নিজের রাজ্য তো বটেই, ভিন রাজ্য থেকেও ডাক পড়ে তারকাদের। আর সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য তাঁরা যে অ্যাপিয়ারেন্স ফি নেন, সেটাও গোপন কথা কিছু নয়। ওই সব তারকাদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শ বা পছন্দ-অপছন্দ বড় ব্যাপার নয়। আজ এক রাজ্যে কংগ্রেসের প্রার্থীর সভায় বক্তৃতা করে কালই অন্য রাজ্যে বিজেপি প্রার্থীর হয়ে রোড শো করতে তাঁদের বাধে না। কিন্ত কোনও একটি দলের খাতায় পাকাপাকি ভাবে নাম লিখিয়ে ফেললে ছবিটা স্বাভাবিক ভাবেই পাল্টে যায়। তখন নিজের দলের হয়ে প্রচার করে কোনও তারকা টাকা নিয়েছেন, এমনটা এত দিন শোনা যায়নি। রাজীব গাঁধীর আমলে কংগ্রেস সাংসদ হয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তখন হামেশাই তাঁকে দেখা যেত দলীয় সভায়। এখন যেমন বিজেপির হেমা মালিনী, পরেশ রাওয়ালদের দেখা যায়। বিধানসভা ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এসেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাজ বব্বর। আর পরেশ রাওয়াল তো খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র ভবানীপুরে সভা করে গিয়েছেন। কিন্তু এঁরা কেউই কখনও সেই বাবদ টাকা নিয়েছেন বলে শোনা যায়নি।

বাংলা যে ব্যতিক্রম তা জানা ছিল না এত দিন। বাম আমলেও বিধায়ক হয়েছেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। ভোটে লড়ে হেরে গিয়েছিলেন অনুপকুমার, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়রা। বামেদের প্রতি আদর্শগত সমর্থনের কথা
ঘোষণা করে তাঁদের হয়ে প্রচারে নেমেছেন আরও অনেকে। এ বারও জোটের প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে পা মিলিয়েছেন টলিউডের একাধিক শিল্পী। কিন্তু তাঁদের কারও বিরুদ্ধেই অ্যাপিয়ারেন্স ফি নেওয়ার অভিযোগ ওঠেনি।

তৃণমূলেই উলটপুরাণ। দলীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত সাত বছর ধরে সাংসদ থাকা এক অভিনেত্রীও এ বার বিধানসভা ভোটে জেলায় জেলায় প্রচারে গিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন! সঙ্গে আসা-যাওয়ার জন্য গাড়ি, বিশ্রামের জন্য হোটেল এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও।

উদারতার ছবিও অবশ্য আছে। স্বয়ং দিদি যেখানে প্রচার করতে
যেতে বলেছেন, সেখান থেকে টাকা নেওয়ার সাহস অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হয়নি। দলের অতি-ঘনিষ্ঠ নেতা-নেত্রীদের আব্দারেও কখনও সখনও ফি মকুব হয়েছে। আর ছাড় পেয়েছেন টলিউডের সতীর্থরা। যেমন, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক অভিনেত্রী বিধায়ক উত্তর চব্বিশ পরগনার এক অভিনেতা-বিধায়কের জন্য বিনা পয়সায় প্রচার করে দিয়েছেন। তবে শর্ত ছিল, উল্টোটাও করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে কী বলছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সীর জবাব, ‘‘এ সব নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আসলে সংবাদমাধ্যমের একাংশ ওঁদের খাস্তা করতে চাইছেন। তবে আমার সঙ্গে ওঁরা কর্মী হিসেব কাজ করেছেন।’’

প্রচারে গিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়ের বিরুদ্ধেও। সেই অভিযোগ সত্যি কি না জানতে চাওয়া হলে শতাব্দী বলেন, ‘‘এটা একেবারেই দলের ভিতরের ব্যাপার। প্রচারে যাওয়ার জন্য কেউ টাকা নেবে কি নেবে না তা দল ঠিক করবে। তা নিয়ে বাইরের কারও জানার অধিকার নেই।’’ যা শুনে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এর মধ্যে দিয়ে অভিযোগের সত্যতাই উনি স্বীকার করে নিলেন। এ-ও বোঝা গেল, এঁরা যে টাকা নিয়ে প্রচার করেন, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানেন। তৃণমূল নেত্রীই এ ভাবে ওঁদের রোজগারপাতির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’’ দল ও তার মতাদর্শের প্রতি এই আনুগত্যহীনতা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর বলেই মান্নানের মত।

চলতি বিধানসভা ভোটে জোট প্রার্থীদের হয়ে প্রচার করেছেন অভিনেতা বাদশা মৈত্র। কখনও কখনও নিজের গাড়ির তেল পুড়িয়েই সভায় গিয়েছেন। শাসক দলে তাঁর সতীর্থরা সে বাবদ টাকা পয়েছেন শুনে তিনি বিস্মিত। বাদশা বলেন, ‘‘এটা শুনে অস্বাভাবিক লাগছে।
এটা যদি হয়ে থাকে, তা হলে কাঙ্ক্ষিত নয় তো বটেই, মানুষ হিসেবেও খুব ব্যথিত হব।’’

বলিউডের দুনিয়া থেকে রাজনীতিতে এসে কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়া বাবুল সুপ্রিয় অবশ্য এমন কাণ্ডে আদৌ বিস্মিত নন। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলে এটাই তো স্বাভাবিক। যে দলে এক নেতা অপরের থেকে তোলা আদায় করেন, সেখানে সব হতে পারে। সব।’’

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy