চাঁপদানির এক ভোটকেন্দ্রে আব্দুল মান্নান। ছবি: প্রদীপ আদক।
বেলা সওয়া ১১টা। বৈদ্যবাটি খন্দকার পাড়ায় ঢুকেই গাড়ির কাচ নামিয়ে অঙ্কের প্রাক্তন শিক্ষক কাছে ডেকে নিলেন সবুজ পাঞ্জাবির যুবককে। হাসি মুখে বললেন, ‘‘তুই নাকি অনেক বড় নেতা হয়েছিস? আয় তোর কানটা মুলে দিই। বাড়িতে গিয়ে বউমার সামনে চড় মারব।’’
বললেন চাঁপদানি কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুল মান্নান। শুনলেন বৈদ্যবাটী পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর সুবীর বসু। না, প্রতিপক্ষের কথায় রেগে অগ্নিশর্মা হননি শাসক দলের নেতাটি। বরং হেসেই জবাব দিলেন, ‘‘না স্যর, বড় নেতা হইনি।’’
বেলা গড়াতে পিয়ারাপুরে দেখা তৃণমূলের আর এক কাউন্সিলরের সঙ্গে। তাঁকেও কাছে ডেকে প্রশ্ন আব্দুল মাস্টারের, ‘‘মস্তানি করছিস? আয় তোর কান মুলে দিই।’’ এ বারও হাসি মুখে সেই কাউন্সিলরের উত্তর, ‘‘না দাদা ভোট ভালই হচ্ছে। আমরা কি এ সব করি?’’
ভোট-দর্শনে বেরিয়ে শুক্রবার এমন ভাবেই গোটা চাঁপদানি চষে ফেললেন মান্নান স্যর। সকাল থেকে বিকেল ভোট-যুদ্ধের অনেক কিছুই দেখলেন, বুঝলেন। কিন্তু প্রার্থীর পরিচয়টা কার্যত সরিয়ে রেখে দক্ষ মাস্টারমশাইয়ের মতো কৌশলে মোকাবিলা করলেন সেই সব ‘দুষ্টুমি’। আর হাসি মুখে বললেন, ‘‘সবই তো আমার হাতে তৈরি। ওঁদের সাহস নেই আমার সামনে এসে কিছু বলার।’’
সকাল থেকেই বেশ খোশ মেজাজেই ছিলেন শেওড়াফুলির কুমোর পাড়ার বাসিন্দা তথা ভদ্রকালী উচ্চ বিদ্যালয়ের অঙ্কের এই প্রাক্তন শিক্ষকটি। সারদা কাণ্ডে সর্ব প্রথম জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন
তিনি। সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের জোটেরও তিনি অন্যতম কান্ডারি। দেখা গেল, নিজেকে জোট-প্রার্থী ভাবার চেয়ে চাঁপদানির আম জনতার ঘরের লোক বলে মনে করতেই বেশি পছন্দ মান্নান স্যরের।
আর তাই বোধ হয় সকাল থেকেই তেমন কোনও টেনশনই ছিল না তাঁর। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দু’টো রুটি, অল্প সব্জির তরকারি আর হাফ গ্লাস হরলিক্স। এর পর চাতরার কুমোরপাড়ায় নিজের বাড়ির দোতলায় বসে ফোনেই কর্মীদের থেকে বিভিন্ন খবর নিচ্ছিলেন। প্রশ্ন করা হল, ‘সন্ত্রাস-রিগিং হলে আটকাবেন কী করে?’
এ বার অবশ্য শিক্ষক নন। মুচকি হেসে জবাব পোড়খাওয়া রাজনীতিকের, ‘‘জনপ্রতিরোধের সব ব্যবস্থা আছে। কেউ আটকাতে পারবে না। প্রয়োজন হলে অন্য জায়গা থেকে মহিলারা এসে রুখে দাঁড়াবেন।’’ যদিও সেই আয়োজন কাজে লাগাতে হয়নি, দিনের শেষে দাবি মান্নান স্যরের।
বাড়ি থেকে বেরোলেন সকাল ৮টায়। প্রথমেই গেলেন গোপীনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে। বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেই রে-রে করে তেড়ে এল কেন্দ্রীয় বাহিনী। স্পষ্টই জানিয়ে দিল, এখানে কথা বলা যাবে না। বিতর্কে না জড়িয়ে এগিয়ে গেলেন মান্নান। বরং বললেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী ঠিকই কাজ করছে। ওঁরা তো শান্তিপূর্ণ ভোট করাচ্ছেন। কোথায় ভোট দিতে হবে তা তো বলছেন না।’’
নিজে শুধু নন, অন্য কেউ অকারণ বিতর্কে জড়ান তা-ও চাননি মাস্টারমশাই। যেমন, চাতরা ও মুসলমান পাড়ার মোড়ের একটি
বন্ধ দোকানের নীচে ক্যাম্প বানিয়ে বসে ছিলেন জনাতিনেক তৃণমূল
কর্মী। সেখানে তৃণমূলের একগুচ্ছ ঝান্ডার মাঝেই কংগ্রেসের একটি পতাকা। তা দেখেই শাসক দলের কর্মীদের মান্নান স্যর বললেন, ‘‘ওরে আমাদের পতাকাটা অন্য জায়গায় লাগিয়ে দে। তোদের সঙ্গে থাকলে আবার কে কী বলবে।’’ মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে বাধ্য ছাত্রের মতো কংগ্রেসের পতাকা অন্যত্র গোঁজার সময়ে শাসক দলেরই এক কর্মী বললেন, ‘‘স্যর বলেছেন যখন মানতেই তো হবে।’’
কিন্তু ক্লাসের সব ছাত্রই বাধ্য হবে, তা কি হয়! আর সেটা ভালই জানেন মান্নান। তাই তারাপুকুরে কয়েকটি বুথে ঘোরার পরেই তাঁর চোয়াল শক্ত হতে শুরু করে। সেখান থেকে বেরিয়ে শ্রীরামপুরে জি টি রোডের উপর দাঁড় করালেন গাড়ি। এ বার আর মাস্টারমশাই নন। প্রার্থী। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিককে ফোন করে অভিযোগ জানালেন।
মল্লিকপাড়া, তারাপুকুরের মতো কয়েকটি জায়গায় তাঁর উদ্দেশে কটূক্তিও করেছে শাসক দলের একাংশ। মান্নান তা এড়িয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘ও সব তো একটু হবেই।’’ তবে কয়েকটি জায়গা বাদ দিলে বেশির ভাগ জায়গাতেই মাস্টারমশাই হিসেবেই যেন সম্মান জানিয়েছেন সকলে। যেমন শেষ দুপুরে শেওড়াফুলি স্টেশনের কাছে প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে কিছু ক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে ঢুকেছিলেন মান্নান। পাশেই তৃণমূলের ক্যাম্প অফিসে তেতেপুড়ে থাকা দলীয় কর্মীরা তেষ্টা মেটাচ্ছিলেন আমপোড়া সরবতে। এক তৃণমূল কর্মী কয়েকটি সরবত ভর্তি বোতল এনে দিয়ে গেলেন ওই নির্বাচনী কার্যালয়ে। ওই তৃণমূল কর্মীর কথায়, ‘‘প্রার্থী আব্দুল মান্নান আমাদের প্রতিপক্ষ। তবে স্যর আমাদের সম্মানীয়।’’
মাস্টারমশাইকে যখন আমপোড়া সরবত দিচ্ছে শাসক দল, তখন কিছুটা দূরের এক বুথে বসে তৃণমূল প্রার্থী মুজফ্ফর খান দাবি করলেন, ‘‘বলতে পারেন তৃণমূল জিতে গিয়েছে। তবে প্রতিপক্ষ মিথ্যা অভিযোগ করে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ডেকে আতঙ্ক তৈরি করছেন। এর থেকেই বোঝা যায় উনি (আব্দুল মান্নান) হারছেন, হেরে গিয়েছেন।’’
শাসক দলের অনেক কর্মীর গলাতেই অবশ্য শোনা গিয়েছে অন্য সুর। তাঁরা বলেছেন, ‘‘জোটের রসায়ন ঠিক থাকলে মান্নান জিতে যেতে পারেন।’’ কিন্তু সত্যিই কি ঠিক ছিল জোটের রসায়ন? চারটি বুথে তো এজেন্টই বসতে পারেননি। রাস্তায়ও তো তেমন চোখে পড়েনি বামেদের পতাকা বা কর্মী!
শুনে হেসেছেন প্রার্থী মান্নান। বলেছেন, ‘‘কৌশল করেই পতাকা লাগানো হয়নি। আর কর্মীরা সবাই আছেন। সব কি আর দেখা যায়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy