চিন ফের খেপেছে। মার্কিন দূতাবাসের পদস্থ কূটনীতিককে ডেকে জানিয়ে দিয়েছে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে যে ভাবে চিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছেন, মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
বেচারি ওবামা! তিনি তিব্বতের ধর্মীয় নেতা চতুর্দশ দলাই লামার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠকে বসেছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকের জন্য নির্ধারিত ওভাল রুমে নয়, একতলায় প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত আলাপচারিতার জন্য নির্দিষ্ট ম্যাপ রুমে। ওবামা এই নিয়ে দু’বার দলাই লামার সঙ্গে বৈঠকে বসলেন, দু’বারই ওই ঘরে। রাষ্ট্রপ্রধানের স্বীকৃতি পেলেন না দলাই। উপরন্তু তিব্বতে মানবাধিকার ছাড়া অন্য কথা হল না। সেটিই স্বাভাবিক! দলাই লামা প্রায় দুই দশক আগে স্বাধীন তিব্বতের দাবি থেকে সরে এসেছেন। তবু ড্রাগনের ফোঁস থামায় কে! চিন বনাম আমেরিকা, একনায়কতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র নিয়ে কয়েক দিস্তা নিবন্ধ আছড়ে পড়ল বলে!
কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের ‘বনাম’-রাজনীতি দিয়ে ঘটনাটার ব্যাখ্যা হয় না। কমিউনিস্ট চিন যদি লামাতন্ত্রের বিরোধী হয়, কেন তিব্বতের বৌদ্ধ মঠগুলি দুনিয়ার সামনে খুলে দেওয়া হল? গ্যিয়ানচেন নোরবু নামে এক বালককেই বা চিন ‘পাঞ্চেন লামা’ হিসাবে নির্বাচন করল কেন? উত্তর খুঁজতে হবে অন্য জায়গায়। উগ্র জাতীয়তাবাদ! দলাই লামা বোধগয়া, সারনাথ বা শ্রাবস্তীতে গেলে চিনের মাথাব্যথা থাকে না। কিন্তু তিনি তাওয়াং গেলেই গরমাগরম বিবৃতি! জাতীয়তাবাদী বেজিং ভাবে, আন্তর্জাতিক সীমারেখা যা বলুক, জায়গাটি আসলে দক্ষিণ তিব্বত!
এই জাতীয়তাবাদ না চিনলে চিনকে বোঝা যাবে না। মাস তিনেক আগেও সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে চিন-জাপান ঝগড়া বেধেছিল। জাপান বলে, ১৮৯৫ সাল থেকে ওই আটটি দ্বীপ তাদের অধিকারে। চিনের পাল্টা বক্তব্য, দ্বীপগুলি তাদের। ইতিহাস ১৮৯৫ নয়, তার ঢের আগে শুরু হয়।
জাতীয়তাবাদের এই নতুন চশমায় চিনকে দেখতে শেখাচ্ছেন ৪৪ বছরের এক বঙ্গসন্তান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর চাইনিজ স্টাডিজ-এ চিনা রাজনীতি ও ইতিহাসের অধ্যাপক রানা মিত্র। তিনি অবশ্য লেখেন রানা মিটার। রানার জন্ম কেমব্রিজে, তাঁর বাবা পার্থ মিত্র শিল্পকলার ইতিহাসবিদ। প্রেসিডেন্সি কলেজে সুশোভন সরকারের ছাত্র পার্থবাবু অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে তাঁর ‘মাচ ম্যানলাইন্ড মনস্টারস’ সুখ্যাত বই।
আর পুত্র? তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘ফরগট্ন অ্যালাই: চায়না’জ ওয়ার্ল্ড ওয়র টু’ বইটি ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। ১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই বেজিংয়ের কাছে স্থানীয় চিনাদের সঙ্গে জাপানি সৈন্যদের হাতাহাতি। তার পর ১৯৪৫ অবধি জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে টানা প্রতিরোধ। ওই লড়াই থেকে জন্ম নিল চিনা জাতীয়তাবাদের অন্যতম চরিত্র: জাপ-বৈরিতা।
মহাযুদ্ধের সময়েই টানা আট বছর জাপানকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে চিন। স্তালিন তখন চিয়াং কাই-শেককে অস্ত্র এবং সমরকৌশলে ইন্ধন জুগিয়েছেন। তাঁর ভয়, জাপান ফুরসত পেলেই সোভিয়েত সীমান্তে আক্রমণ শানাবে। ব্রিটেনও কম যায়নি। তার ভয়, চিন নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে জাপান অচিরে বার্মা এবং ভারতে হানা দেবে। চিন-জাপান লড়াই না থাকলে যুদ্ধের ফল কী হত, বলা যায় না। তবু যুদ্ধশেষে পশ্চিমি শক্তি চিনকে মনে রাখেনি। ভুলে-যাওয়া মিত্র। ফরগট্ন অ্যালাই!
এই বই সরকারি ইতিহাসের বিরোধিতা। রানা দেখান, জাপানের সঙ্গে যুদ্ধই কমিউনিস্ট পার্টিতে নরমপন্থীদের কোণঠাসা করে দেয়, মাও এবং হার্ডলাইনাররা ক্ষমতা দখল করেন। নইলে ইতিহাস অন্য রকম হত। চমকপ্রদ ব্যাপার বইটি চিনা ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। “ওই যে, জাতীয়তাবাদ! চিনের গৌরবের কথা যদি থাকে, সরকারি ভাষ্যের বিরোধিতা করলেও ওরা মেনে নেয়,” বলছিলেন লেখক। জাতীয়তাবাদের গন্ধ থাকলে অন্তত তিন-চার রকম পুষ্প নতুন চিনে বিকশিত হয়।
জাতীয়তার আরাধনা? চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নয় দশক পূর্তি।
এই চিনা জাতীয়তাবাদ কোনও উপনিবেশের হাত ধরে আসেনি। নিজের সভ্যতা নিয়ে চিন বরাবর আত্মগর্বে গরীয়ান। ছাপাখানা, বারুদ থেকে জনস্বাস্থ্যের টিকা, আমলাতন্ত্র সব কিছুর জন্ম তার মাটিতে। রানা একটা ঘটনা বলছিলেন। ১৮৩০ সালে লি রুঝেন নামে এক চিনা ঔপন্যাসিক লিখছেন, ‘চিনই স্রষ্টা, অন্য দেশের সভ্যতা তার থেকেই শুরু।’ তখনও ‘বন্দে মাতরম্’ দূর অস্ত, নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয়নি।
বিশ শতকে এই ইন-বিল্ট জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যোগ হল দুনিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়ার ইচ্ছা। রানার ‘আ বিটার রেভলিউশন: চায়নাজ স্ট্রাগ্ল উইথ মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে একটি ঘটনার কথা আছে। ৪ মে, ১৯১৯। দুপুর ২টো নাগাদ বেজিং-এর তিয়েনআনমেন গেট থেকে ছাত্রছাত্রী, কেরানি নির্বিশেষে প্রায় তিন হাজার লোকের মিছিল রওনা হল তথ্যমন্ত্রী গাও রুলিন-এর বাড়ির দিকে।
মহাযুদ্ধের শেষে, দিন কয়েক আগে শুরু হয়েছে ভার্সাই চুক্তি নিয়ে আলোচনা। পরাজিত প্রুশিয়ান সাম্রাজ্যের কোন অংশ কার পাতে যাবে, তা নিয়ে কথাবার্তাও শেষ। মিত্রপক্ষের সমর্থনে, চিনের প্রধানমন্ত্রী দুয়ান গিরুইয়ের সরকার প্রায় ৯৬ হাজার শ্রমিক পাঠিয়েছিল পশ্চিম রণাঙ্গনে। চিনের স্বার্থ একটিই। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালির প্রতিশ্রুতি: যুদ্ধের পর চিনের জিয়াওঝু, গুয়াংদো বন্দরের জার্মান উপনিবেশ ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু এপ্রিলের শেষে সব হিসাব উল্টে গেল। প্রতিশ্রুতির বালাই না রেখে উপনিবেশগুলি দেওয়া হল জাপানকে। মিত্রপক্ষ জানে, চিনের চেয়ে জাপান অনেক শক্তিশালী, বিশ শতকের শুরুতেও রাশিয়াকে যুদ্ধে হারিয়েছে তারা।
সেই ঘটনার প্রতিবাদেই মিছিল গাও রুলিনের বাড়ির দিকে। দরজা বন্ধ, সামনে পুলিশের কর্ডন। স্লোগান আর চিৎকারের মধ্যে এক ছাত্র ব্যানার ছুড়ে দিল ছাদে, অন্যরা জানলা ভেঙে ভিতরে। বেগতিক দেখে পুলিশের পোশাক পরে পালিয়ে গেলেন গাও। অন্য এক মন্ত্রীকে পিটিয়ে অজ্ঞান করে দিল ছাত্ররা।
কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলেদের মারকুটে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনের কারণ নিহিত বহু দূরে প্যারিসে। ছাত্ররা চায় পরিবর্তন। বৈজ্ঞানিক চিন্তায়, গণতান্ত্রিক বোধে ঋদ্ধ এক দেশ। কেউ কেউ বলছে, কনফুসিয়াসের প্রাচীন নীতি রাজাকে ভক্তি, বাবাকে শ্রদ্ধা, সামাজিক শৃঙ্খলা ছুড়ে ফেলে দাও।
এই আন্দোলনকে অস্বীকার করতে পারেননি কোনও নেতা। পরে মাও জে দং বলবেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল, ৪ মে’র আন্দোলন তারই প্রথম ধাপ। সেখান থেকে শুরু সাংস্কৃতিক বিপ্লব।’ জাতীয়তাবাদী চিয়াং কাই-শেক আবার জানাবেন, ‘একটা ভুল ছিল। আধুনিকতা মানে কনফুসিয়াসকে ছুড়ে ফেলা নয়। তাঁর নীতির সঙ্গে সাযুজ্য ঘটিয়ে এগোতে হবে।’
৯৫ বছর আগের এই ইতিহাস চমকে দেয় ভাঁজে ভাঁজে। প্রথমত, দেং জিয়াও পিং তো সে-দিনের ব্যাপার, প্রথম মহাযুদ্ধেই চিন ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে হিসেবনিকাশ কষছিল। দ্বিতীয়ত, কনফুসিয়াস-বিতর্ক। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নতুন প্রধান সি জিনপিং দিন কয়েক আগেই জানিয়েছেন, ‘পশ্চিমি ধনতন্ত্রে আজকের আর্থিক মন্দায় কনফুসিয়াস দিশা দেখাতে পারেন।’ তা নিয়ে অনেক হাসাহাসি হল। কিন্তু একটা ঘটনা পরিষ্কার। চিনে ‘আধুনিকতা’র অন্যতম বিষয়: কনফুসিয়াসের সঙ্গে বোঝাপড়া। “শুধু মাও, কমিউনিস্ট পার্টি বা দেং-এর বাজার অর্থনীতি দিয়ে চিনকে বোঝা যায় না। মাও আর দেং মোটেই পরস্পরবিরোধী নন। দু’জনেই চেয়েছেন শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র এবং তাকে চালনার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র ক্ষমতা। তফাত একটাই। মাও কনফুসিয়াস-নীতিকে প্রাচীন কুসংস্কার ভাবতেন। দেং সেখান থেকে সরে আসেন,” বলছিলেন রানা।
তৃতীয়ত, কমিউনিস্ট মাও এবং জাতীয়তাবাদী চিয়াং কাই-শেক সকলেই ৪ মে-র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মেনে নিচ্ছেন। যাবতীয় বিভেদ সত্ত্বেও চিনা জাতীয়তাবাদ যে কমিউনিস্ট চিন এবং প্রজাতন্ত্রী তাইওয়ানকে এক দিন পাশাপাশি বৈঠকে এনে দেবে, আশ্চর্য কী! “মাও এবং চিয়াং কাই-শেক দু’জনেই দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী এবং একনায়ক,” বললেন রানা।
প্রশ্ন উঠতেই পারে। সমাজতন্ত্র মানে মানচিত্রের সীমানা ভেঙে দিকে দিকে সর্বহারার বিপ্লব! তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ মেশে কী ভাবে? কিন্তু দুনিয়া কবে আর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গেয়ে হাঁটল? সোভিয়েত জমানা ছিল উজবেকিস্তান বা কাজাখস্তানের মাটিতে মস্কোর সাম্রাজ্যবাদ। আর চিন? অক্সফোর্ডের বঙ্গসন্তান প্রমাণ করে দিলেন, দেং জিয়াও পিং-কথিত ‘চিনা সমাজতন্ত্র’ শুধু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং উদার অর্থনীতি নয়। সেখানে মিশে আছে জাতীয়তাবাদ।
এই জাতীয়তাবাদকে ‘আধুনিকতার সঙ্গে অসম্পূর্ণ বোঝাপড়া’ বলে অভিহিত করছেন রানা। তাঁর যুক্তি, কোরিয়া, জাপান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম জুড়ে গোটা কনফুসীয় সভ্যতাকেই চিন নিজস্ব উত্তরাধিকার ভাবত। নিজের দেশ তার কাছে দুনিয়ার কেন্দ্র বা ‘মিড্ল কিংডম’। মাঞ্চুরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত কাউকেই পাত্তা দিত না। উনিশ শতকে সে দেশে শুরু হল আধুনিক জাতিরাষ্ট্র তৈরির চেষ্টা। সাবেক সভ্যতা আর আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের বয়ান মিলেমিশেই চিনের বর্তমান রাজনীতি।
দুনিয়া চিনল না আধুনিকতার অসমাপ্ত সেই বয়ান, জানল না হিমালয়ের পড়শিও। উল্টে অরুণাচল প্রদেশে ভোটপ্রচারে গিয়ে শক্তিমান এক নেতা চিনের ‘এক্সপ্যানশনিস্ট মাইন্ডসেট’ ছাড়া অন্য কিছু মনে হল না। “১৯৬২-র আতঙ্ক। লাদখ, অরুণাচলে পরিস্থিতি তপ্ত হলেই ভারত স্মৃতি হাতড়ায়। অথচ, চিনে সেই যুদ্ধ সকলে ভুলে গিয়েছেন। সে বছর মাওয়ের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড শুরু, তাতে ওই যুদ্ধের চেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল,” বললেন রানা।
দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে প্রভাব বাড়াতে গেলে তাই চিনা দখলদারির কথা বলে লাভ নেই। জাতীয়তাবাদ আর হান সভ্যতার টানাপড়েনে গড়ে-ওঠা রাষ্ট্রটিকে এ বার ঠিকঠাক চিনে নেবার সময় এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy