দা দরি অঞ্চলের বাসিন্দা পিতৃহারা অষ্টাদশী সাজিদা একটি গুরুতর প্রশ্ন তুলিয়াছেন। দাদরি গণহত্যার হেতু হিসাবে পরিচিত যে মাংস মহম্মদ আখলাকের বাড়ির ফ্রিজ হইতে বাহির করিয়া ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হইয়াছিল, তাহা গোমাংস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত না হইলে কি সেই রাত্রে নিহত তাঁহার পিতা ফিরিয়া আসিবেন? তরুণী সাজিদার প্রশ্ন ভারতীয় রাজনীতির অবিশ্বাস্য গতিপ্রকৃতির একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে তির ছুড়িতে পারিয়াছে। তাঁহার প্রশ্নটিকে ঘুরাইয়া এই ভাবেও বলা যায় যে, ফরেন্সিক পরীক্ষায় যদি আজ বাহির হয় ওই মাংস গোমাংস ছিল, তবে কি সে দিন দাদরির নৃশংস হিন্দুত্ববাদী হত্যাকারীরা উচিত কাজই করিয়াছিল বলিয়া বোঝা যাইবে? তাহাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ বাতিল হইবে? নতুবা, বাড়িতে গোমাংস রাঁধিবার ও খাইবার অভিযোগে গভীর রাত্রে যখন এক দল দুর্বৃত্ত আসিয়া মুসলিম পরিবারের উপর চড়াও হইয়া নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়, পুলিশ-প্রশাসনের নিকট মাংসটি গোমাংস কি না তাহা পরীক্ষা করাই কী ভাবে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হইয়া উঠে? গোমাংস খাওয়া যদি ওই গ্রামের সমাজের কাছে অ-গ্রহণযোগ্যও হয়, তাই দিয়া এত নৃশংস একটি অপরাধের গুরুত্ব কী কোনও ভাবে কমিতে পারে? প্রশাসনিক তরফে যে সম্প্রতি আবার নূতন করিয়া জানানো হইয়াছে যে ওই বাড়িতে সে দিন গোমাংসই ছিল, তাহার বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়া প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি-বা মানিয়াও লওয়া হয় যে এই নূতন সিদ্ধান্তটিই ঠিক, তাহাতে কত দূর কী আসিয়া-যায়? তদন্ত বা বিচারে কতখানি পরিবর্তন আসিতে পারে?
স্পষ্ট কথা স্পষ্ট ভাবেই বলা দরকার। দাদরি হত্যাকাণ্ডটি গত অক্টোবরে ঘটাইয়াছিলেন যে গো-রক্ষাবাদী, মৌলবাদী দুর্বৃত্তরা, বিষয়টির মধ্যে আগাগোড়া সাম্প্রদায়িক স্ফুলিঙ্গ রাখিয়া দিবার জন্য উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনও কিন্তু এক অর্থে তাঁহাদের সমান দায়ী। প্রশাসনের তরফে এক বারও জোর দিয়া বলা হয় নাই যে, এই ফরেন্সিক পরীক্ষা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। গণতান্ত্রিক দেশে খাদ্যাভ্যাসের কারণে কাহাকেও হত্যা করা ভয়ানক স্তরের অপরাধ, সুতরাং এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত সকলেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাইবার কথা। উত্তরপ্রদেশে কিংবা অন্যত্র গোমাংস খাইবার অধিকার আছে কি না, তাহা ভিন্ন ভাবনার বিষয়। যদি সেই অধিকার না-ও থাকে, তবে অপরাধীরা শাস্তিযোগ্য কি না, তাহা বিচারের বিষয়। সেই সব স্তর পার হইয়া এই যে উন্মাদ গুন্ডামি, ফরেন্সিক পরীক্ষা তাহাকেই প্রশ্রয় দিতেছে মাত্র। তদন্ত ও বিচারের নামে এই প্রহসন ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে সংখ্যাগুরুবাদের তাণ্ডব নৃত্য।
প্রশাসনের দায়িত্ব অন্য ভাবেও সহজবোধ্য। কোনও অঞ্চলে এতখানি সাম্প্রদায়িক সংবেদনশীলতা থাকিলে, হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের এতখানি আঁচ টের পাইলে প্রশাসনের কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকে। অথচ বিসাহরা গ্রামে আখলাক পরিবারের ঘটনা ঘটিয়া যাইবার পরও সেখানকার মুসলিম অধিবাসীদের নিয়মিত ভাবে ত্রস্ত, বিপন্ন করিয়া রাখা হইতেছে, হুমকি ও অত্যাচারের প্রাবল্যে একের পর এক মুসলিম পরিবার গ্রাম ছাড়িতেছে। তাঁহাদের নিরাপত্তা দিবার কেহ নাই, কেননা তাঁহারা গণতন্ত্রের ‘ভারতীয়’ অবতারের নাগরিক। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নিয়ন্ত্রিত মহাপঞ্চায়েতের সৌজন্যে অসহিষ্ণুতা ক্রমশই ধাপে ধাপে বাড়িতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নীরবতাও হিরণ্ময়-তর হইতেছে। এই তীব্র অসহনের খবর চাপা নাই। ভারতের বৃহৎ কয়েকটি মেট্রোপলিসের পাশেই তাই আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গুরুত্বে দাদরি দ্রুত তাহার স্থান করিয়া লইতেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের উষ্ণীষে নূতন পালক— দাদরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy