Advertisement
৩০ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

অ-সমান

মধুর অভাবে গুড় চলিতেই পারে, কিন্তু সমৃদ্ধ মৌচাক নাগালে থাকিতেও চিন-ভারত কূটনীতির পরিচালকরা বছরের পর বছর গুড়ের নাগরিতে পরিতৃপ্ত! দিল্লিতে এবং বেজিংয়ে এক নায়ক যান, আর এক নায়ক আসেন, আমন্ত্রণ এবং প্রতি-আমন্ত্রণ চলে, সফরের জবাবে সফর, নায়ক বদলাইলে ভাবভঙ্গি বদলায়, ভারতে খাবারও চিনা প্রেসিডেন্টের জন্য ধোকলার আয়োজন হয়, কিন্তু শেষ পাতে মধু আর পড়ে না।

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মধুর অভাবে গুড় চলিতেই পারে, কিন্তু সমৃদ্ধ মৌচাক নাগালে থাকিতেও চিন-ভারত কূটনীতির পরিচালকরা বছরের পর বছর গুড়ের নাগরিতে পরিতৃপ্ত! দিল্লিতে এবং বেজিংয়ে এক নায়ক যান, আর এক নায়ক আসেন, আমন্ত্রণ এবং প্রতি-আমন্ত্রণ চলে, সফরের জবাবে সফর, নায়ক বদলাইলে ভাবভঙ্গি বদলায়, ভারতে খাবারও চিনা প্রেসিডেন্টের জন্য ধোকলার আয়োজন হয়, কিন্তু শেষ পাতে মধু আর পড়ে না। চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের সফরে চিন-ভারত সীমান্ত সমস্যার সমাধানকল্পে ‘আলোচনা চলিবে’ নামক বহুশ্রুত অসার বার্তাটি আরও এক বার শুনাইয়া দেওয়া হইল। অথচ সমস্যার সমাধান অনেক আগেই হইয়া গিয়াছে। ১৯৬২ সালের সংঘর্ষের পরে দুই দেশের মধ্যে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা’ যেখানে স্থির হইয়াছিল, সেটিকে সীমান্ত হিসাবে স্বীকার করিয়া লইলেই গোল চুকিয়া যায়। দীর্ঘ সময় ধরিয়া ওই নিয়ন্ত্রণ রেখাটি সীমান্তের কাজই করিতেছে। কিন্তু পশ্চিমে আকসাই চিন এবং পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ, দুই অঞ্চলই প্রতিপক্ষের নিকট আজও ‘বিতর্কিত এলাকা’। থাকিয়া থাকিয়া ‘সীমান্ত সংঘর্ষ’ মারফত সেই বিতর্কের ভূতটিকে জাগাইয়া তোলা হয়, কিছু দিন তাহা লইয়া শব্দক্ষয় চলে, যেমন লাদাখের চুমার-এ চিনা অনুপ্রবেশ লইয়া সম্প্রতি চলিতেছে, আবার দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার শান্তিজল ছিটাইয়া ভূতকে ঘুম পাড়াইয়া দেওয়া হয়। নায়করা ভয় পান, সমাধান করিলেই স্বদেশে ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ধুয়া উঠিবে, প্রতিপক্ষের নিকট আত্মসমর্পণের দায়ে পড়িবেন। গণতান্ত্রিক ভারতে এই ভয় বেশি। নরেন্দ্র মোদীর পক্ষেও ভয় কাটানো দুঃসাধ্য। অতএব সীমান্ত নামক মৌচাকটিকে কেহ ছুঁইবে না। সমাধান মজুত থাকিতেও ‘আলোচনা চলিবে’।

চলুক। তাহাতে চিন-ভারত অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ সম্পর্কের অগ্রগতিতে বাধা নাই। সেখানে প্রশ্ন অন্য। সম্পর্কটি কেমন হইবে? ভারত এবং চিন, দুই দেশের নাম এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করিয়া ভারতীয় মন আহ্লাদিত হইতে পারে, জয়রাম রমেশ ‘চিন্ডিয়া’ শব্দের স্রষ্টা হিসাবে এক দিন ভারতরত্ন লাভ করিতে পারেন, কিন্তু বাস্তব এই দুই প্রতিবেশীকে বহু দূরে ঠেলিয়া দিয়াছে। চিনের অর্থনীতির বহর ভারতের প্রায় পাঁচগুণ, শিল্প-উত্‌পাদনের ক্ষেত্রে দূরত্ব আরও অনেক বেশি। ফলে ভারত আজও চিন হইতে শিল্পজাত পণ্য কিনিয়া এবং চিনকে আকরিক লৌহাদি কাঁচামাল সরবরাহ করিয়া চলিয়াছে এবং বাণিজ্যে বিপুল ঘাটতির বোঝা বহন করিতেছে। চিনা বিনিয়োগ বাড়াইয়া এই অসামঞ্জস্যের উত্তর খুঁজিতে ভারত অনেক দিনই তত্‌পর, কিন্তু কেবল তত্‌পর হইলেই বিনিয়োগ আসে না, সুতরাং শি চিনফিংয়ের সফরে দশ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি মিলিবার আশা শেষ অবধি দুই হাজার কোটি লইয়া মিটাইতে হইয়াছে মধুর অভাবে গুড়। চিন-ভারত সম্পর্ক সমানে-সমানে নহে, অদূর ভবিষ্যতে তেমন হইবারও নহে।

কিন্তু অসমান সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ হইতে পারে। চিন এবং ভারত, কেহই পরস্পরকে অগ্রাহ্য করিতে পারে না। এই সত্যও অস্বীকার করিতে পারে না যে, তাহারা প্রতিবেশী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী। চিন পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় আপন প্রভাববলয় বিস্তারের যে ধারাবাহিক চেষ্টা চালাইতেছে, ভারতকে তাহার প্রতি সচেতন থাকিতে হইবে, আপন প্রভাববলয় বিস্তারে মনোযোগী হইতে হইবে। কিন্তু তাহার প্রথম শর্ত অর্থনৈতিক শক্তিতে শক্তিমান হওয়া। চিনের উত্থান এবং আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস সেই শিক্ষা দেয়। অর্থনীতির জোর না থাকিলে সেই অভাব অন্য ভাবে পূরণ করা যায় না। মধুর অভাবে গুড় চলিবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy