আসানসোল শহর থেকে প্রায় ৪০ কিোটারমি উত্তর-পুবে উখড়া। উখড়া বেশ প্রাচীন জনপদ। এই অঞ্চলের সব জনপদের মতোই উখড়ারও নিশ্চয়ই ছিল এক বনগ্রামের শৈশব, কিন্তু তার বাড়বাড়ন্ত কয়লাখনির সঙ্গে জড়ানো। আজকের চারপাশে বড় বড় পোখরিয়া খাদ বা ওপেন কাস্ট মাইনসে ঘেরা ফুলে ফেঁপে ওঠা বাজারপ্রধান উখরাকে দেখে ১০০ বছর আগেকার সচ্ছল জনপদটিকে ভাবা সহজ নয়। কিন্তু তার ঘরের ভেতর উঁকি দিলে কিছু প্রাচীন, কিংবা হয়তো ততো প্রাচীনও নয়, কেবল ধুলোয় ঢাকা পড়া, সামাজিক ইতিহাসের ছবিগুলি এখনও দেখা যায়।
সেই বাড়বৃদ্ধির চেহারাটিও অদ্ভুত। এখনকার, কিংবা বলা ভাল ২০-৩০ বছর আগেকার, উখড়ায় সবচেয়ে সম্পন্ন পরিবার দু’টি শিকড়গত ভাবে বাংলার বাইরের বহুদূর থেকে আসা— বাজপেয়ী আর হান্ডা। আন্দাজ করা কঠিন নয়, কয়লাশিল্পের শুরুর দিকে এই দুই পরিবারের আদি পুরুষরা ব্যবসার কারণে সেই নতুন গড়ে ওঠা শ্রমিক জনপদে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরে তাঁরা ওতপ্রোত ভাবে মিশে গিয়েছেন প্রান্ত-বাংলার এই অঞ্চলের সমাজে। ভাষায়, সংস্কৃতিতে। উখড়ার স্থানীয় ইতিহাস ভূগোলের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে এই বাজপেয়ী মোড়, বাজপেয়ী রথযাত্রা, হান্ডাবাড়ি, হান্ডাদের গোপিনাথ জিউয়ের মন্দির, সেখানে স্থাপিত স্কুল। এমনকি, এই পরিবারের কন্যা বিষণকুমারী হান্ডার বিয়ে হয় বর্ধমানের রাজপরিবারে। অল্পবয়সে বিধবা এই বিষণকুমারীই বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী বলে শোনা যায়।
এ গেল উখড়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিচয়ের রূপরেখা। কিন্তু কথায় বলে, ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’। অতি সাধারণ গৃহস্থালীতে বসবাস করা এই জনপদের এক জন পণ্ডিত মানুষ আর তাঁর কল্যাণী মমতাময়ী স্ত্রী-র কথা এখনও পর্যন্ত বৃহত্তর আসানসোলের মানুষেরা শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে করেন।
১৯১৯ সালে পণ্ডিত মাগারাম চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছিল উখরা গ্রামের আর পাঁচটি সাধারণ পরিবারের মতো দরিদ্র কিন্তু শ্রীসম্পন্ন বিদ্যোৎসাহী একটি পরিবারে। দেবতার কাছে বহু প্রার্থনার ফলে এই পুত্রের জন্ম, সেই বিশ্বাসে মা ছেলের নাম রাখলেন মাগারাম। পরিবারের অল্প জমিজায়গা ছিল। কিন্তু তাঁর বাবা-মায়ের আগ্রহে খুব আদরের সন্তান হয়েও ছোট বয়সেই গ্রামের টোলে পড়াশোনা করতে যান বালক মাগারাম। ছাত্রবৃত্তি পেয়েছেন প্রথমাবধি। তার পরে যখন ভর্তি হন গ্রামের পুরনো স্কুল কুঞ্জবিহারী ইনস্টিটিউশনে, ততো দিনে উজ্জ্বল বুদ্ধিমান ছাত্র হিসেবে গ্রামে যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছেন কিশোর মাগারাম। ‘গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা’ ফল করে ম্যাট্রিক পাস করার পরে বর্ধমানে উচ্চশিক্ষা শেষ করে আবার নিজের গ্রামের এই স্কুলেই ফিরে আসবেন তিনি।
তখন গ্রামের সব উঁচুনিচু ভেদ সত্ত্বেও এক রকমের পারিবারিকতার বোধ থাকত। গ্রামের দেবালয় সংলগ্ন জলাশয়, পাঠশালা তৈরি করে দেওয়া, বৃত্তিজীবীদের নিষ্কর জমি দেওয়া— এ সব ‘জমিদার’ বা ধনী পরিবারদের সামাজিক দায়িত্ব বলে ধরে নেওয়া হত। উখরার জমিদারদের কাছারি মাগারামের উচ্চতর শিক্ষার আর্থিক দায়দায়িত্ব নেওয়ার কারণে বর্ধমান থেকে ভাল রেজাল্ট করে বিএ পাশ করেন তিনি। উল্লেখযোগ্য যে, সে সময়ে কলকাতার বাইরে স্নাতক ছাত্রের সংখ্যা ছিল খুব কম, যাঁরা ভাল ভাবে সেই শিক্ষা লাভ করতেন, তাঁদের নিয়ে চাকরি জগতে টানাটানি পড়ে যেত। বেশি বেতনের চাকরি, সামাজিক সম্মান, পারিবারিক সচ্ছলতা— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এক জন স্নাতকের সামনে ‘সফলতা’র দরজা ছিল খোলা। তবু, মাগারাম ফিরে এলেন গ্রামে। ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই শেষলগ্নে দেশজোড়া লোভ, লালসা, মূল্যবোধহীনতার সময়ে সামান্য বেতনে নিজের বাল্যের স্কুল কুঞ্জবিহারী ইনস্টিটিউশনে সংস্কৃতের শিক্ষক হয়ে যোগ দিলেন। কী টেনেছিল তাঁকে? দেশময় উথলে ওঠা স্বরাজের ভাবনা? যা তাঁকে বাধা দেয় বিদেশি প্রভুর গোলামি করতে? নাকি আপন জীবনের আদর্শ হিসেবে সচেতন ভাবেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার বদলে গ্রামের সেই সাধারণ, এমনকি, হয়তো কিছুটা দারিদ্রের জীবনও, যা তাঁকে সুযোগ দেবে নিজের গ্রামটির অবস্থা কিছুটা ভাল করে তোলার? আমরা ঠিক জানি না। কিন্তু তাঁর পরের জীবনের দিকে তাকিয়ে এটাই মনে হয়।
নাগরিক জীবনের লোভ কাটিয়ে মাত্র ২৬ বছরের উজ্জ্বল মেধাবী যুবকটি গ্রামে ফিরে এলেন, পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতাকে। ১৯৪৫ সালে সংস্কৃত শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন নিজের বাল্যের স্কুলে। পরে একটানা ৪০ বছর এই একই কাজ করে গিয়েছেন। নিজের গ্রামটির ভাল-মন্দে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পৃক্ত। গ্রামের মানুষদের কাছে যে কোনও বিপদে, সমস্যায়, আনন্দে ঠিক উপায় বলে দেওয়ার, সান্ত্বনা দেওয়ার নির্ভরযোগ্য স্থল। বছরের পর বছর গ্রামের স্কুলটি থেকে পাশ করে যাওয়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী নিজেদের জীবন শুরুর লগ্নে এ রকম এক জন স্নেহময়, শুভচিত্ত শিক্ষকের উদাহরণ সামনে পেয়েছিল।
শিক্ষক হিসেবে যা উপার্জন করেছেন তার সঙ্গে ছিল দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটি বড় পরিবার। সম্ভাবিত আর্থিক সাচ্ছন্দ্য তাই ছিল না, কিন্তু প্রশান্তির অভাব হয়নি। জীবনের এ সব সুখে-দুঃখে প্রকৃত সহধর্মিণী হয়ে পাশে ছিলেন শ্রীমতী মায়াদেবী। বস্তুর অভাব চিরদিন পূরণ করেছেন যত্ন আর ভালবাসা দিয়ে। ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন, একই সঙ্গে সাধ্যমত লালন করেছেন অভাবী ছাত্রদের।
লোকে বলে ‘আদর্শ শিক্ষকের কোনোদিন অবসর নেই’। চাকরিজীবন শেষ করার পরেও অবসর নেননি মাগারাম চক্রবর্তী। গ্রামের হনুমানডাঙায় কিছুটা জমি ছিল। সেখানে একটি গ্রামীণ মাটির বাড়িতে বসবাসের সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই শুরু করেন গ্রামের প্রান্তিক পরিবারগুলির শিশুদের লেখাপড়া শেখানো। প্রায়ই অভুক্ত বা অপুষ্ট বাচ্চাগুলির কারও না কারওর চালও ফুটত মায়াদেবীর ভাতের হাঁড়িতে। নিজের সংসারের প্রতি কর্তব্য পালনেও ত্রুটি রাখেন নি মা-বাবা হিসেবে, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, বিবাহ সম্পন্ন করেছেন নিজেদের মতো করে। মাগারাম ও তাঁর পত্নীর কাছে এটাই ছিল স্বাভাবিক জীবনের চেহারা, এর জন্য তাঁরা কোনও দিন আলাদা কোনো ‘বড়ত্ব’ দাবি করেন নি। সেই ‘বড়’ বলে, স্মরণীয় মানুষ বলে সম্মান তাঁদের আশপাশের মানুষেরাই দিয়েছেন।
এ বছর সেই আদর্শবান নির্লোভ মানুষটির জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। আজকের সংকীর্ণ স্বার্থভাবনায় পরিকীর্ণ, উদ্ভ্রান্ত দিনকালে এমন এক জন শুভবুদ্ধির মানুষকে স্মরণ করা আমাদের সামাজিক কর্তব্য। মাগারামের দুই সফল পুত্র ও পরিবারের সঙ্গে তাঁর গুণগ্রাহীরাও নিশ্চয়ই এই মানুষটির স্মৃতিকে কোনও স্থায়ী কল্যাণমূলক কাজে উপযুক্ত মর্যাদা দেবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy