Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

নিরুদ্দিষ্ট

সার্বভৌমত্বের ধারণা ও তন্মধ্যে নিহিত আত্মসম্মানবোধের দ্যোতনা যদি এই শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের অন্তরে প্রবেশ না করে, তাহা বাঙালির পক্ষে মহা আক্ষেপের বিষয়।

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০১:১৫
Share: Save:

বাঙালির প্রিয় বহু বস্তুই নিরুদ্দিষ্ট হইয়াছে, কিন্তু আত্মসম্মানবোধটুকুও নিরুদ্দিষ্ট হইলে, বড় বেদনার কারণ ঘটিবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের এক অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয়, সম্ভবত এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। তাহার উপাচার্য নিজ কার্যের অসুবিধা বা তজ্জনিত ক্ষোভ জানাইতে হইলে অবশ্যই আচার্যের বাড়ি যাইতে পারেন, কিন্তু তিনি প্রথমেই কিনা মন্ত্রীর বাড়িতে ছুটিলেন! ইহাতে তিনি যে আসনটিতে বসিয়া অছেন, তাহার সম্মান সমধিক হৃত হইল না কি? মন্ত্রী বরং প্রয়োজন হইলে উপাচার্যের নিকট সময় চাহিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিতে পারেন। প্রশ্নটি নিছক দেখা করা বা না করার নহে। প্রশ্ন গভীরতর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করিয়া এই উষ্মা ঘনীভূত যে, ভর্তি-প্রক্রিয়ায় সরকার নাক গলাইতেছে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী মনে করেন, নিরানব্বইটি জায়গা ভাল হইলেও এইটি খারাপ। ‘হোক কলরব’ আন্দোলন-কালে, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের পক্ষ হইতে অনেকেই এমন মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল মাদকাসক্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতার পীঠস্থান। কিন্তু বিদ্বেষপরায়ণ হইবার প্রসঙ্গ এক, আর দখলদারির প্রশ্ন অন্য। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কী পদ্ধতিতে ছাত্র নির্বাচন করিবে, তাহা লইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরের কাহারও কিছু বলিবার অধিকার নাই। সে বিশ্ববিদ্যালয় ভাল হইলেও নাই, খারাপ হইলেও নাই। প্রশ্নটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান লইয়া নহে, সার্বভৌমত্ব লইয়া। এই সার্বভৌমত্বের ধারণা ও তন্মধ্যে নিহিত আত্মসম্মানবোধের দ্যোতনা যদি এই শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের অন্তরে প্রবেশ না করে, তাহা বাঙালির পক্ষে মহা আক্ষেপের বিষয়।

শুনা যায়, এই বাংলারই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রখ্যাত উপাচার্য ছাত্র আন্দোলন সামলাইতে হিমশিম খাইতেছিলেন, তখন তাঁহাকে কেহ পরামর্শ দেয় পুলিশ ডাকিতে। উত্তরে তিনি তাঁহার প্রাথমিক স্তম্ভিত ভাব কাটাইয়া দৃঢ় ভাবে জানাইয়া দেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে পুলিশ ঢুকিয়া তাঁহার ছাত্রদের ধরপাকড় করিবে, ইহা তিনি কল্পনাও করিতে পারেন না। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয় একটি পবিত্র একাধিকার-বিশিষ্ট স্থান, তাহার চূড়ান্ত সঙ্কটেও সেই মৌলিক মর্যাদাসূত্র লঙ্ঘন করিবার কোনও প্রশ্নই উঠে না। সন্দেহ নাই, এই পবিত্রতাকে কলুষিত করিবার প্রয়াস শুরু হইয়াছিল এই রাজ্যে বেশ কিছু বৎসর পূর্বেই। পরিকল্পিত ভাবেই প্রতিটি বিদ্যায়তনে দলদাস ঢুকাইয়া এবং যাঁহারা দলানুগত নহেন তাঁহাদের অপদস্থ করিয়া বামফ্রন্ট একটি মেরুদণ্ডহীন রাজ্য নির্মাণ করিতে চাহিয়াছিল। আজও যদি সেই ঐতিহ্যই চলিতে থাকে, রাজনৈতিক চাপ সামলাইয়া কাজ করা যদি দুঃসাধ্য হয়, তবে আত্মসম্মান, এবং প্রতিষ্ঠানের সম্মান রক্ষার্থে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের পদত্যাগ করাই হয়তো একমাত্র সম্মানজনক কর্তব্য। ইহা কি কল্পনা করা যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে কেহ শিখাইয়া দিতেছেন, কী ভাবে ছাত্র ভর্তি করিতে হইবে? আধুনিক বাঙালি সেই ‘বিদ্রোহী’ মনীষীদের পূজা করে, যাঁহারা লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, আত্মসম্মান বিসর্জন দেন নাই, কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে বলে, আপস করিতেই হইবে, কারণ ডাউন পেমেন্ট হইয়া গিয়াছে।

ইহা সকল ক্ষেত্রেই ছড়াইয়া পড়িয়াছে। অর্থ বা নিরাপত্তা বা খ্যাতির স্বার্থে নিজ আদর্শকে বিসর্জন দিয়া নির্লজ্জ ক্ষমতাতোষণ করা যায়, এবং তাহা যে করে না সে-ই যে মূর্খ, ইহা সমাজে স্বীকৃত। চলচ্চিত্রকার ছবি করিয়া চলিবার জন্য রাজনীতিকের নির্দেশে মিছিলে যোগ দেন, কবি মুখ্যমন্ত্রীর কেদারা প্রক্ষালন করেন, সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনীতি করিয়া খ্যাত মানুষ কেদারার লোভে উলটা শিবিরে যোগ দিয়া ক্যামেরার সম্মুখে বুক ফুলাইয়া দাঁড়ান। সাধারণ মানুষ তো এই পথে গমন করিয়া অতি তৃপ্ত। এই বাঙালির কিছু দিন পূর্বেও বাড়ি-গাড়ি হইবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না, সম্পদ বলিতে ছিলেন কিছু ধুতি ও টুইলের শার্ট পরিহিত হতদরিদ্র বাপ-দাদা-কাকা, যাঁহারা মাথা উঁচু করিয়া চলিতেন এবং ‘না’ নামক এক ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করিতে জানিতেন। স্বমর্যাদাই ছিল তাঁহাদের বৈভব। আজ তাঁহারা নাই, তাঁহাদের উত্তরাধিকার ‘আত্মসম্মানবোধ’ও ল্ুপ্তপ্রায়। তবে হ্যাঁ, সামান্য অংশ হয়তো এখনও সত্তায় লাগিয়া অাছে। না হইলে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যাইবার পর, শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সম্মুখের নহে, পিছনের দরজাটি খোলা ছিল কেন?

যৎকিঞ্চিৎ

কে না জানে, বাঙালির বিরুদ্ধে গোটা পৃথিবী সর্ব ক্ষণ চক্রান্ত করছে। তারা যে দুটো দলকে ভালবাসে, তাদের বিশ্বকাপে হারিয়ে দেওয়া হল। রেফারিরা ন্যায্য পেনাল্টি দিলেন না, আজেবাজে কার্ড দেখালেন। ইউরোপকে জয়ী করে, লাতিন আমেরিকা তথা বাঙালির মতো দারিদ্রপীড়িত কিন্তু শিল্পোচ্চ জাতিগুলোকে হ্যাটা করার কল এগুলো। তাও ফ্রান্সকে সমর্থন করা যায়, বাঙালি তো নিতান্তই ফরাসিদের তুতোভাই, কিন্তু তারাও যদি হারে? সই সংগ্রহ করতে হবে, পিটিশন!

অন্য বিষয়গুলি:

Student College
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy