জুন মাসের মধ্যভাগে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ যশবন্ত সিন্হার উদ্যোগে দিল্লিতে আটটি বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা সমবেত হইয়াছিলেন। ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী জানাইয়া দিলেন, তিনি সর্বভারতীয় পরিসরে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত। এই মুহূর্তে তিনি দিল্লিতে বিভিন্ন বিরোধী নেতানেত্রীর সহিত দেখা করিয়াও সেই একই বার্তা দিতেছেন। উল্লেখ্য, ২১ জুলাইয়ের ‘ভার্চুয়াল’ অনুষ্ঠানে এ বার তাঁহার আমন্ত্রণে বিভিন্ন বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা যোগ দিলে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নিজস্ব বার্ষিক সভাটিতে যেন সর্বভারতীয় মাত্রা যুক্ত হইল। এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী সেই মঞ্চ হইতে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে লক্ষ্য করিয়া নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দলের বিপরীতে বিরোধী ঐক্য গড়িবার ডাক দিয়া বলিলেন, তাহার প্রস্তুতি অবিলম্বে শুরু করা জরুরি। এই ঘোষণায় তথা অভিযানে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর ব্যক্তিগত বা দলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কী ভূমিকা আছে, সেই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক চণ্ডীমণ্ডপে অতঃপর বিস্তর কাকলি ও কূজন চলিবে। কিন্তু বৃহৎ প্রশ্নটি ব্যক্তি বা দলের স্বার্থ লইয়া নহে, ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য তথা ভবিষ্যৎ লইয়া।
শাসকের একাধিপত্যের প্রতিষেধক হিসাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে শক্তিগুলি অত্যাবশ্যক, তাহার মধ্যে সবল ও সক্রিয় বিরোধী দলের স্থান সর্বাগ্রে। ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব অবস্থায় কোনও একটি দলের পক্ষে সেই প্রয়োজন পূরণ করা এখন বা অদূর ভবিষ্যতে অসম্ভব। বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে জোট বাঁধিতে হইবে। শাসক দলের প্রচারকরা স্বভাবতই এমন জোটকে বিরোধিতা-সর্বস্ব নেতিবাচক আঁতাঁত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহিবেন, কিন্তু শাসক যখন গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করিতে বদ্ধপরিকর, তখন তাহাকে ক্ষমতা হইতে উৎখাত করিবার সংগঠিত গণতান্ত্রিক রাজনীতি অপেক্ষা ইতিবাচক আর কিছু হইতে পারে না। সেই রাজনীতির স্বার্থে, গণতন্ত্রের বিপদ প্রতিহত করিতে বিরোধী দলগুলি নিজেদের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত বা মতানৈক্যকে দূরে সরাইয়া রাখিবে— ইহা কাণ্ডজ্ঞানের কথা।
প্রশ্ন হইল, বিরোধী দলগুলি কি সেই প্রস্তাব মানিবে? তাহাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সাম্প্রতিক আচরণ ঐক্যের সম্ভাবনাকে কিছুটা অগ্রসর করিয়াছে। শরদ পওয়ার এবং সনিয়া গাঁধীর মতো নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সাড়া দিয়াছেন বলিলে কম বলা হইবে। অন্য নানা দল হইতেও মঞ্চে আসিবার এবং থাকিবার স্পষ্ট সঙ্কেত মিলিতেছে। বলা বাহুল্য, বেশ কিছু ক্ষেত্রে রাজ্য রাজনীতির স্বার্থ বিভিন্ন বিরোধী দলের সম্মুখে ঐক্যের পথে বাধা সৃষ্টি করিতে পারে। কিন্তু রাজ্য রাজনীতিকে রাজ্যের স্তরে সীমিত রাখিয়া সর্বভারতীয় সমন্বয় সাধনই এখন জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীদের কাজ। আশার কথা, এই বোধের সঙ্কেত নানা দল হইতে মিলিতেছে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী তৃণমূল কংগ্রেসের সহিত সহযোগিতার প্রশ্নে বিজেপি-বিরোধী মঞ্চ নির্মাণের বাধ্যবাধকতাকে গুরুত্ব দিয়াছেন। সিপিআইএম অবশ্য যথারীতি আপন অহমিকার কূপে নিমজ্জিত। কেরল নামক ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাঁহারা আপাতত কাটা সেপাইয়ের ভূমিকায়, সুতরাং তাঁহাদের লইয়া অধিক বাক্যব্যয় নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তববাদী জ্যোতি বসু ও সহমর্মীরা প্রথমে সত্তরের দশকে এবং পরে আশির দশকে জাতীয় রাজনীতির প্রয়োজনকে কী ভাবে রাজ্য রাজনীতির স্বার্থ হইতে স্বতন্ত্র ভাবে দেখিয়াছিলেন, সেই ইতিহাস হইতে সামগ্রিক ভাবেই বিরোধী রাজনীতির শিক্ষা লইবার আছে। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প— বহুচর্চিত কথাটি স্মরণ করিতেই হয়, কারণ বিরোধী রাজনীতির নবনির্মাণের সম্ভাবনা তৈয়ারি হইয়াছে। সংসদ অধিবেশনে তাহার নির্ভুল সঙ্কেত মিলিতেছে। উদ্যোগপর্ব এখনই শুরু হওয়া জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy