ফাইল চিত্র।
পঞ্চনদীর তীর হইতে কংগ্রেস ‘হাই কমান্ড’-এর একটি দীর্ঘশ্বাস বুঝি আরব সাগরের উপকূলে গিয়া পৌঁছাইল। সেই দীর্ঘশ্বাস বেদনার। বেদনায় হয়তো কিঞ্চিৎ ঈর্ষাও মিশিয়া আছে। এক দিন কংগ্রেসের দিল্লীশ্বরেরা চক্ষের পলকে রাজ্যে রাজ্যে দলীয় সরকার ও সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটাইতেন, মন্ত্রী-সান্ত্রি-সভাপতিরা ঘুম ভাঙিয়া জানিতেন, চেয়ার সরিয়া গিয়াছে। হাই কমান্ডের মহিমা আরও উজ্জ্বল হইত। আজ আর সেই সুখ নাই। জীর্ণ ঝুলিতে গুটিকয়েক রাজ্য, কার্যত প্রত্যেকটিতেই অবিরত অন্তর্দ্বন্দ্ব। পঞ্জাবে তাহারই প্রকোপে মুখ্যমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হইল। আসন্ন নির্বাচন সামলাইবার তাগিদে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই পরিবর্তনে বাধ্য হইলেন। শেষ অবধি নূতন মুখ্যমন্ত্রীও বাছিয়া লওয়া হইল। কিন্তু যে ভাবে, যে টানাপড়েনের মধ্য দিয়া সেই পর্ব উন্মোচিত হইয়াছে, তাহা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে স্বস্তির নহে, সম্মানেরও নহে। ইহার পরেও তাঁহারা ঘর সামলাইতে পারিবেন কি না, স্পষ্ট নহে তাহাও। অন্য দিকে, গুজরাতেও মুখ্যমন্ত্রী বদলাইল, বদলাইয়া গেল গোটা মন্ত্রিসভাই। সেইখানেও অদূরবর্তী নির্বাচনের দিকে চাহিয়াই বিজেপি হাই কমান্ড সম্মার্জনী চালনা করিলেন। ভূতপূর্ব উপমুখ্যমন্ত্রী নিতিন পটেল প্রমুখ বিদায়ী তথা প্রত্যাশী কেষ্টবিষ্টুদের অসন্তোষ এবং ক্ষোভ অনিবার্য, তাহার অল্পবিস্তর সঙ্কেতও মিলিয়াছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসকদের নির্দেশনায় সামগ্রিক বিচারে রূপান্তরটি মসৃণ ভাবেই সম্পন্ন। গাঁধী পরিবারের দীর্ঘশ্বাসের স্পর্শে মোদী-শাহের চিত্ত পুলকিত হইতেই পারে। তাঁহারা বলিতেই পারেন— বর্তমান আসিয়া অতীতকে লইয়া গিয়াছে।
কিন্তু এই বর্তমান অতীতের পুনর্মুদ্রণমাত্র। যে বিজেপি এক কালে নিজেকে ‘অন্য রকম’ দল বলিয়া অহঙ্কার করিত, সে এখন অম্লানবদনে কংগ্রেসের পুরানো পথেই চলিতেছে। কেবল গুজরাত নহে, বিভিন্ন রাজ্যেই দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আলোচনা ও মতামত যাচাইয়ের পথে তাহার নিরসনের যথার্থ গণতান্ত্রিক মার্গ দর্শনের সাধ্য এই দলের নাই, সম্ভবত ইচ্ছাও নাই। রাজধানী যাহা হুকুম করিবে, রাজ্যের মনসবদারগণ ‘যথা আজ্ঞা’ বলিয়া তাহা মানিয়া লইবেন, ইহাই এখন বিজেপির ‘স্বাতন্ত্র্য’। এই খেলায় কংগ্রেসকে সে হারাইয়া দিয়াছে, কিন্তু খেলাটি কংগ্রেসেরই। বস্তুত, এমন খেলায় সাফল্যের জন্য যে একাধিপত্যের সংস্কৃতি বিশেষ উপযোগী, তাহা নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির মজ্জায় মজ্জায় অতি প্রবল। মোদী-শাহির দাপট ইন্দিরা-শাহিকেও যে কোনও সময় দশ গোল দিতে পারে। গুজরাত তাহার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন।
গণতান্ত্রিক বহিরাবরণ বজায় রাখিয়া এই এককেন্দ্রিক আধিপত্যবাদ কত দিন এবং কত দূর বজায় থাকিতে পারে? গুজরাতের উদাহরণটি তাৎপর্যপূর্ণ। বিজয় রূপাণীর সরকারের অপদার্থতা তাহার আমূল পরিবর্তনের একমাত্র কারণ নহে। তাহার সহিত কাজ করিয়াছে জাতপাতের অঙ্ক, বিশেষত পাটীদারদের ক্ষোভ প্রশমনের তাগিদ। মণ্ডল বনাম কমণ্ডলুর লড়াইয়ে মণ্ডলের জয় এখন প্রাচীন ইতিহাস, জাত-ভিত্তিক রাজনীতির জটিল পথে ভারত অনেক দূর চলিয়া আসিয়াছে, বিজেপিও নিস্তার পায় নাই, তাহার অখণ্ডমণ্ডলাকার হিন্দুত্বের মূর্তি জাতিবর্ণের বিবিধ আবর্তে পড়িয়া ক্ষতবিক্ষত। এই ধরনের জটিলতা রাজ্য বা আঞ্চলিক স্তরে নিরসন করিতে পারিলে একটি স্বাস্থ্যকর রাজনীতি তৈয়ারি করা যায়, দিল্লির আদেশে সব দ্বন্দ্ব মিটাইবার চেষ্টায় আঞ্চলিক সমস্যাগুলি উত্তরোত্তর জটিল হইতে জটিলতর হইয়া শেষ অবধি কেন্দ্রীয় শক্তিকাঠামোটিকেই বিপাকে ফেলে। কংগ্রেস তাহা ঠেকিয়া শিখিয়াছে। বিজেপি দেখিয়া শিখিতে পারিত, কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ এই দলের তথা পরিবারের ধর্মে সহিবে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র শেষ অবধি এই একাধিপত্যবাদকে প্রতিহত করিতে পারিবে, না নিজেই পরাহত হইবে, তাহাই শেষ প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy