শোভাযাত্রা: রোড-শো’য় জনতার ভিড় সঙ্গে নিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বারাণসী, ১ মে। রয়টার্স
ধরা যাক, একটা রাজনৈতিক দল প্রচারসভা করল ব্রিগেডে। যে লোকরা তাতে জড়ো হয়ে ভিড় জমিয়ে সংবাদমাধ্যমে ‘ঐতিহাসিক’ ‘অভূতপূর্ব’ ‘জনারণ্য’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হল, তাদের প্রায় ষাট শতাংশকেই দলের পক্ষ থেকে খাবারদাবার যাতায়াত-খরচ এবং হাতে-নগদ টাকা দেওয়া হল। অস্বস্তির কিছু নেই। সব দলই যে এ রকম করে থাকে, আমরা সবাই জানি। কথাটা নীতির চেয়েও বেশি অর্থনীতি নিয়ে। আচ্ছা, এই যে ভিড়-প্রতি খরচ, যা নির্বাচনের আগে শয়ে-শয়ে সভার জন্য করা হয়, যাকে বিশেষজ্ঞরা বলেন ‘পেড পলিটিক্যাল পার্টিসিপেশন’-এর ‘নাম্বার্স’, ওটা কি ঘুষ? না কি স্রেফ প্রয়োজনীয় বৈধ খরচ? এর কি কোনও হিসেব আছে? খোঁজখবর করলে দলের বিলবইতে কি পাওয়া যাবে এই সব ‘নাম্বার’?
আবার ধরা যাক, মন্ত্রী গেলেন দলের হয়ে ভোটপ্রচারে বাঁকুড়া কিংবা মালদহ। কয়েকটা জায়গায় ঘুরলেন তিনি, রাতে থাকলেনও। কে দিল সেই খরচ? সরাসরি সরকারি ভাণ্ডার থেকে খরচ করা মুশকিল হতে পারে, দলের প্রচার বলে কথা। তা হলে নিশ্চয় অন্যরাই ‘বুক’ করে দিল ঘর। দারুণ কিছু না হলেও, খরচের ‘হেড’গুলো যোগ করলে টাকার পরিমাণটা মন্দ হওয়ার কথা নয়। আচ্ছা, এই যে ‘অন্যরা’, এরা কেন খরচ করল সেটা প্রশ্ন না হলেও— কত খরচ করল, সেটা তো একটা প্রশ্ন বটে? কোনও হিসেব কি পাওয়া সম্ভব, দলের পান্ডাদের কাছে খোঁজ করলে?
এই সবের একটাই উত্তর। না! ভোটপ্রচার এমন জিনিস, যার সার্বিক খরচের সন্ধান পাওয়া অ-সম্ভব। যা কিছু এ বিষয়ে বলার, সবটাই আন্দাজের ভিত্তিতে। এবং তার ফলে, এ কাজ আমাদের মতো সাধারণ প্রাণীর বোধবুদ্ধির বাইরে। অঙ্কবিদ্যা, সমাজবিদ্যা এবং রাজনৈতিক বিদ্যায় যাঁরা সমান দক্ষ, তাঁরাই কেবল আন্দাজটা সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেন। তাঁদের আন্দাজের উপর নির্ভর করেই আমাদের কাজ চালাতে হবে।
সেই রকম দক্ষ গবেষকরা এ বার একটা কথা বলছেন। বলছেন, ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনটি আক্ষরিক অর্থেই ‘ঐতিহাসিক’। এত বিরাট বিপুল খরচ পৃথিবীর কোনও নির্বাচনে আগে দেখা যায়নি। টেনিদার ভাষায়, ব্যাপার সত্যি ‘পুঁদিচ্চেরি’! টাকা-ডলারের অসমতা সত্ত্বেও, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো কর্পোরেট টাইকুনের জন্য মেগাস্কেলের ভোটপর্ব সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু দীনদরিদ্র ভারতবর্ষের পিছনেই পড়ে গিয়েছে! দিল্লির সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ়-এর হিসেব, ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা। তার মানে, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারকেও (দুটোই, যাকে বলে রক্ষণশীল হিসেব) ছাপিয়ে এ বার মেরা ভারত মহান। ওই সংস্থা জানাচ্ছে যে, ২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের থেকে এ বারে খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশ— ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশের জনসংখ্যার ছবিটা মাথায় রাখলে, মাথাপিছু ৮ ডলার খরচ নির্বাচনের বাজারে, যেখানে দৈনিক মাথাপিছু আয় ৩ ডলার। মার্কিন ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস থেকে প্রকাশিত পত্রিকার হিসেব বলছে, ভারতীয় নির্বাচন শেষ হতে হতে খরচের পরিমাণ ২০১৪ সালের দ্বিগুণ মানে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা।
এই সবই কিন্তু সরকারি ভাবে ঘোষিত খরচ। অর্থাৎ খরচের একটা দিকমাত্র। কিছু দিন আগে ওই পত্রিকাতেই পড়া গিয়েছে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সিমোঁ শোশা-র ভারতের নির্বাচনী খরচ নিয়ে একটি জরুরি বিশ্লেষণ। মহারাষ্ট্রে বেশ কয়েক বছর ধরে ঘুরে ঘুরে সমীক্ষা চালিয়ে তিনি দেখেছেন যে, রক্ষণশীল হিসেবমতে এই যে বৈধ খরচ, সেটা ভোটপ্রচারের মোট খরচের একটা ‘মিনিস্কিউল’ বা অতিক্ষুদ্র অংশমাত্র, ৩০ ভাগের এক ভাগ (সাড়ে তিন শতাংশ), কিংবা ৫০ ভাগের এক ভাগ (২ শতাংশ)! বাকি অংশের মধ্যে একটা বিরাট পরিমাণ ‘গিফট’ বা হাতে-টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত থাকছে, যার পরিমাণ কেবল আন্দাজলভ্য। হাতে হাতে ‘ক্যাশ ট্রান্সফার’ কোথায় কী ভাবে হচ্ছে, তা জানা যায় না, কেননা বহু সময়েই সেটা দলের নামে হয় না— ভূতের রাজার বরের মতো হাঁক দিলেই তার জোগান আসে, অ-লক্ষ্যে, অ-নামে। নিয়মছাড়া হিসেবহীন সেই টাকা।
এই হিসেবহীন টাকার মধ্যে আজকাল থাকছে একটা বিরাট পরিমাণ বিদেশি টাকা। বিষয়টা ভারী গোলমেলে, ইতিমধ্যে ফ্রান্স আর আমেরিকার নির্বাচনে অন্য দেশ থেকে পাওয়া ভোট-ফান্ডিং নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয়েছে, মামলাও চলছে। আমাদের দেশেও ফরেন ফান্ডিং এখন পুরোদমে। এই বারের নির্বাচনে সেই ফান্ডিং নাকি চোখ কপালে তোলার পর্যায়ে। বলা বাহুল্য, ব্যস্তসমস্ত বিদেশভ্রমণকারী প্রধানমন্ত্রীর দলই তার প্রধান প্রাপক।
ভোটখরচের বহরে সকলের চোখ এমন কপালে উঠেছে যে, মার্চে একটা অল-পার্টি মিটিং হয়ে গেল দিল্লিতে, নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে আলোচনা হল নির্বাচনী প্রচারে দলপ্রতি সর্বাধিক কত টাকা ব্যয় করা বৈধ, তাই নিয়ে। প্রশ্ন হল, এই ব্যয়ের কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকা উচিত কি না। মিটিংয়ে দেখা গেল, সমস্ত পার্টি এক দিকে, বিজেপি আর এক দিকে। ঊর্ধ্বসীমার প্রস্তাবে একশো শতাংশ ‘না’ বিজেপির।
দেখেশুনে আমরা বলতেই পারি, খরচের আন্তর্জাতিক ‘রেকর্ড’-এ দেশকে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই নরেন্দ্র মোদীর। সে দাবি তাঁর ‘মিশন শক্তি’ বা প্রতিরক্ষা স্যাটেলাইট তৈরির দাবির থেকে অনেক বেশি সত্য ও যথার্থ হবে! বিজেপির ভোটখরচ নিয়ে যা শোনা যায় তার কতটা ঘটনা আর কতটা রটনা, জানেন শুধু মোদী-শাহ যুগল। আমরা কেবল কয়েকটা গুঞ্জরিত কথা উল্লেখ করতে পারি।
গত রবিবার মধ্যপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ প্রেস কনফারেন্সে বললেন, বিজেপির কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হচ্ছে, নেতাদের স্ত্রীরা তাঁদের সমস্ত গয়নাগাঁটি বেচে টাকা জোগাড় করেছেন। শুধু তো ভোটখরচ নয়, এর মধ্যেই ৭০০ কোটি টাকা খরচ করে বিজেপির অফিস তৈরি হয়েছে দিল্লিতে। এত যে প্লেন ও হেলিকপ্টারে আকাশ এফোঁড় ওফোঁড় করছেন তাঁরা (এবং আসমুদ্রহিমাচল বিজেপির ‘পোষ্য’ নেতারা), সেই খরচ কোথা থেকে আসছে, আমাদের বলুন মোদী— দাবি কমল নাথের।
ঠিক তার আগের দিন, শনিবার ২৭ এপ্রিল, আম আদমি পার্টির নেতা সঞ্জয় সিংহ নির্বাচন কমিশনের কাছে নালিশ জানালেন: কমিশন যেখানে এক-একটি রোড-শো’এর জন্য খরচের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করেছে ৭০ লাখ, সেখানে মোদীর একটি বারাণসী-সভার জন্য খরচ হয়েছে ১.২৭ কোটি!
ক’দিন আগে রাহুল গাঁধীও প্রশ্ন তুলেছেন মোদীর খরচ নিয়ে। একটা ৩০ সেকেন্ডের টিভি-বিজ্ঞাপনের জন্য, বা সংবাদপত্রের পাতায় বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ হয় কয়েক লক্ষ টাকা। এত দিন ধরে এত পরিমাণ বিজ্ঞাপনের খরচ মোদীর দল জোগাচ্ছে কী করে? নিজেদের পকেট থেকে নয় নিশ্চয়ই?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তমলুকের সভায় দাবি তুলেছেন, মোদীর খরচের হিসেব প্রকাশ্য করা হোক। তাঁর সভায় নাকি মুম্বই, দিল্লি থেকে লোক আনা হয়, মিটিং-মিছিলে গেলে বাইক অবধি কিনে দেওয়া হয়। ‘‘ওঁর বাড়িতে কি টাকার গাছ আছে?’’
জানুয়ারি মাসে ইন্ডিয়া টুডে-র রিপোর্ট বলেছিল, নির্বাচনের আগেই বিজেপির আনুমানিক নির্বাচনী খরচ দাঁড়াচ্ছে এক লক্ষ কোটি টাকা! আর, এই অসামান্য খরচের দায় চোকাতে হবে পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারকে— ভাঁড়ার খালি হয়ে যাওয়ার দায়! সেই ‘দায়’ মেটানোর পাশাপাশি, কেন এত খরচ হল সেই ‘দায়িত্ব’ কিন্তু কেউ নেবেন না, কেননা ভোটখরচের ক্ষেত্রে ভারতে ‘জ়িরো ট্রান্সপারেন্সি’, কারও কোনও দায়বদ্ধতা নেই। নির্বাচনী কমিশনের গাইডলাইন আছে বটে এ বিষয়ে, কিন্তু বর্তমান শাসক দল মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে তাকে বিদেয় করেছে।
গুঞ্জরণের এ সব সাতপাঁচ ভাবতে গিয়ে একটা কথা পরিষ্কার। বিজেপির বিরুদ্ধে এত রকম অনিয়মের অভিযোগের পরও নির্বাচন কমিশন কেন নীরব নির্বাক, তা নিয়ে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকেছেন— এমন কাণ্ড অভূতপূর্ব হলেও, হাজারো অভিযোগের মধ্যে ভোটখরচের অভিযোগটা যেন কোথায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। অথচ, যে দেশে নির্বাচন মানেই দাঁড়িয়েছে টাকা দিয়ে ভোট কেনা, অন্তত ভোট কেনার চেষ্টা— সেখানে কিন্তু এইটাই প্রধান অভিযোগ হওয়ার কথা ছিল। গুনগুন গুঞ্জন নয়, প্রতিবাদের নির্ঘোষ তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কোথায় সেই নির্ঘোষ, মহামান্য বিরোধীগণ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy