Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
অল্প লইয়া থাকি না, তাই
Coronavirus

এই অতিমারি কি আমাদের স্বল্পতার শিক্ষা দিয়ে গেল

এক ক্ষুদ্র ঘরে মাত্র তিনটি জামা, চার জোড়া ট্রাউজ়ার্স, চার জোড়া মোজা আর সামান্য কিছু সরঞ্জাম নিয়ে বসবাস করে সাড়া ফেলেছেন ফুমিয়ো সাসাকি।

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২১ ০৬:২১
Share: Save:

শূন্যতাই জানো শুধু?

শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে

সেকথা জানোনা? —শঙ্খ ঘোষ

চলতি অতিমারি, অনেক কিছুর সঙ্গে, একটা শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেল। অল্প নিয়ে থাকার শিক্ষা। আমাদের প্রয়োজন, রুচি, চাহিদা, জীবনযাত্রার মান এক নয়। সকলকে এক সারিতে দাঁড় করানো তাই চলে না। তবু সন্দেহ নেই, পৃথিবী এক পণ্যরতিময় যাপন আর ক্রয়সর্বস্ব সংস্কৃতিতে ডুবে। এই সংস্কৃতি যে নিশ্চিত ভাবে আমাদের পূর্ণতার আনন্দ এনে দিচ্ছে, বিষাদ, বিচ্ছেদ, শূন্যতাকে সহজ করে দিচ্ছে, তেমন নয়। এই অতিমারির ভিতর যেন বোঝা গেল, জীবনে মূল্যবান দিকগুলো আসলে কী! হয়তো বোঝা গেল, বস্তুসর্বস্ব সঞ্চয়, এবং তার ব্যবহারে কিছুটা রাশ টানতে পারলে, তা শান্তি এনে দিতে পারে। অল্পে খুশি থাকার শিক্ষা আমাদের কাছে নতুন নয়, ভারতের দার্শনিক, কবি, ধর্মগুরু, সাধক, সন্ন্যাসীরা যুগে যুগে আমাদের এই জ্ঞানের সন্ধান দিয়ে এসেছেন। শুধু দু’টুকরো অঙ্গবস্ত্রের দারিদ্র, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ‘মহাত্মা’ হয়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়নি। কিন্তু এই অল্প নিয়ে চলার শিক্ষাকে অবলম্বন করে সহজ, অনাড়ম্বর, উদ্বেগহীন, আনন্দময় জীবন আমরা গড়ে তুলতে পারলাম কি? পণ্য ও ক্রয় সংস্কৃতির পথিকৃৎ হয়েও, স্বল্পতার এই জ্ঞানকে, বরং জাপান তার জাতীয় সাধনার অঙ্গ করে তুলেছে, যার উপর অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে ভারতীয় ভাবনার ছায়া, যা মূলত বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে সেখানে বিস্তৃত হয়েছিল।

একটা গল্প। জাপানের পরাক্রমশালী শাসক তোয়োতোমি হিদেয়োশি তাঁর চা-উৎসবের গুরু, সেন-নো-রিক্যিউ-এর (১৫২২-১৫৯১) বাগান আলো করা ‘আজিসাই’ (মর্নিং গ্লোরি) ফুলের খোঁজ পেয়ে, নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে আগাম জানিয়ে, চা-কুটির সংলগ্ন বাগানে পৌঁছে দেখেন, চার পাশে ফুলের চিহ্নমাত্র নেই। ক্রুদ্ধ, দাম্ভিক যোদ্ধা-শাসক প্রায়-শূন্য, সঙ্কীর্ণ চা-কুটিরে প্রবেশ করে দেখলেন, বছরের সেরা একটিমাত্র শিশিরস্নাত ফুল, ফুলদানিতে সাজিয়ে তাঁর অপেক্ষায় বসে স্থিতধী আচার্য রিক্যিউ। হিদেয়োশি বুঝলেন, ‘এক’-এর সৌন্দর্য আর অদ্বিতীয়তার আভাস দিতেই ‘অনেক’কে নির্মম ভাবে সরিয়ে ফেলেছেন রিক্যিউ। স্বল্পের ভিতরেও যে সুন্দর, বৃহৎ আর অসীমের দেখা পাওয়া সম্ভব— জাপানের সাহিত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, চা-উৎসব, উদ্যানশিল্পে তেমন উদাহরণ অজস্র রয়েছে। বিশ্ববিশ্রুত জাপানি ‘উকিওয়ে’ শিল্পী কাত্‌সুশিকা হোকুসাইয়ের একটা ছাপাই-ছবির কথাই ধরা যাক, যিনি এক ঢেউয়ে অতলান্ত এক মহাসমুদ্রের আভাস দিয়ে গিয়েছিলেন, যা তাঁর ‘থার্টি সিক্স ভিউস অব মাউন্ট ফুজি’ শীর্ষক চিত্রমালার অন্তর্ভুক্ত। ১৯১৬ সালে প্রথম বার জাপান ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ য়োকোহামায় বিত্তবান রেশম ব্যবসায়ী ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক সান্‌কেই হারার সুবিশাল বাগানঘেরা বাড়িতে কিছু দিন ছিলেন। সেখানে তাঁর জাপানি বালিকা-পরিচারিকার ‘ওয়াকা’ কবিতাচর্চার গুরু, কবি নোবুৎসুনা সাসাকিকে, সম্ভবত ভেবেচিন্তেই, বহু আগে লেখা এক কবিতার চার পঙ্‌ক্তি লিখে দিয়েছিলেন। “অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর/ যাহা যায় তাহা যায়।/ কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে/ প্রাণ করে হায়-হায়।” ‘ওয়াকা’ কবিতা সামান্য কিছু শব্দে লেখা হয়, যেখানে প্রতিটা শব্দের গুরুত্ব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত জাপানের কাব্যে এই স্বল্পতার শক্তি এবং অসীমতাকে স্বীকৃতি দিতেই নিজের এই ভাবনা বেছে নিয়েছিলেন। জাপানের নান্দনিকতার ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছিলেন, সুন্দরের আনন্দকে খুঁজে পেতে তার চার পাশে এক শূন্যতার আবরণ কত জরুরি, যাকে তিনি বলবেন, ‘বিরলতার অবকাশ’। রবীন্দ্রনাথ জাপানে ঘুরে মনে করেছিলেন, শূন্যতা মানে কিছু না-থাকা নয়, শূন্যতা মানে স্বাধীনতা। চার পাশটা খালি হয়ে গেলেই, সেই শূন্যতাকে আমরা ভয় পাই, তার ভিতরে স্বাধীনতা আর আনন্দের ঢেউ আমরা অনুভব করতে পারি না বলেই। তাই যেন আড়ম্বর দিয়ে শূন্যকে পূর্ণ করার একটা ভুল খেলায় মেতে থাকি। এক ক্রয়সর্বস্ব, পণ্যরতিময় সংস্কৃতির প্রতি আমাদের নিবিড় আসক্তি, শেষ অবধি আমাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে ওঠে।

রোজকার জীবনের কথাই ধরা যাক। বাড়িঘরের কথা। সর্বত্র ছড়িয়ে কত আসবাব আর জিনিস। দৃষ্টি, মন আর ভাবনার সঞ্চালনের অবকাশ নেই। ক্রমাগত সংগ্রহ আর সঞ্চয়ের প্রবণতার পরিণতি— সব কিছু ঠাসাঠাসি করে রাখা আর দেখানোর উদ্যোগ, যাকে অনেক সময় আমরা বলছি, ‘সাজানো’, আর তার সঙ্গেই সব হারানোর ভয়। এই যা আছে তাই দেখানো আর সাজানোর উদ্যোগকে জাপানি নন্দনবেত্তা কাকুজো ওকাকুরা তাঁর প্রখ্যাত বই, দ্য বুক অব টি-তে এক ‘চূড়ান্ত অশ্লীলতা’ বলে মনে করেছিলেন। জাপানের চা-উৎসবের নান্দনিকতা আর আদর্শে প্রাণিত হয়ে তিনিও স্বল্পতা আর শূন্যতার মর্ম বুঝতে শিখিয়ে গিয়েছিলেন। ক্রয়, আহরণ আর সঞ্চয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মায়া। কী রাখব, কী ফেলব, কোনটা জরুরি, কোনটা বাড়তি বুঝে উঠতে আমরা যখন নাজেহাল, তখন তারই কিছু সমাধান উপস্থাপন করে, দু’-একটা বই লিখে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের মারিয়ে কোন্দো। তারই একটার নাম, দ্য লাইফ চেঞ্জিং ম্যাজিক অব টায়ডিং। তাঁর উপদেশ শিরোধার্য করে, জীবন এবং বাড়ির বাড়তি সামগ্রী বিসর্জন দেওয়ার উপায়, বিশ্বে এখন পরিচিত, ‘মারি কোন্‌ টেকনিক’ হিসাবে। তাঁর মোদ্দা কথা, যে কোনও কিছু ছুঁয়ে দেখতে হবে। তার স্পর্শ শরীরে যদি এক খুশির হিল্লোল তুলে যায়, তাকে আগলে রাখার কারণ রয়েছে। যদি কোনও ধাক্কা না লাগে, অনায়াসে তাকে বাতিলের খাতায় ঠেলে দেওয়া ভাল। মারিয়ে কোন্দোর এই আপাত সহজ, ছোট্ট উপদেশ বিশ্বে এখন রীতিমতো ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনেকে দেখছেন, তা কোনও তরঙ্গ তুলে যায় কি না। কোন্দো অবশ্য জড়বস্তুর ভিতরেই মূলত নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন, মানুষের সম্পর্কের ভার নিয়ে কিছু বলেননি।

জাপানে এক ক্ষুদ্র ঘরে মাত্র তিনটি জামা, চার জোড়া ট্রাউজ়ার্স, চার জোড়া মোজা আর সামান্য কিছু সরঞ্জাম নিয়ে বসবাস করে সাড়া ফেলেছেন ফুমিয়ো সাসাকি। স্বল্পতাকে আশ্রয় করে তাঁর এই যাপন তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন একটি জনপ্রিয় বইয়ে, যার নাম গুডবাই, থিংস: অন মিনিমালিস্ট লিভিং। এক সময় বস্তুকেন্দ্রিক জীবন কী ভাবে তাঁর মনের গতি স্তব্ধ করে দিয়েছিল, কী ভাবে বহু কিছু বাতিলের খাতায় ঠেলে তিনি জীবনের আনন্দ ফিরে পান, তার বর্ণনা রয়েছে এই বইয়ে। জাপানের রোজকার জীবনচর্চায় এই ‘মিনিমালি‌‌জ়ম’কে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সাসাকি বলেছেন যা অত্যাবশ্যক শুধু তাকে আগলে রেখে বাকি সব বর্জন করার কথা, তেমনই বলেছেন যা চলার পথে প্রকৃত মূল্যবান তাকে স্বীকার করে উপযুক্ত কদর দেওয়ার কথাও। চার পাশের বাড়তি জঞ্জাল বিসর্জন দেওয়া আসলে যে দৃষ্টি আর মনকে ভারমুক্ত রাখারই উপায়, জাপানের স্বল্পতাবিলাস বার বার সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জাপানের সংস্কৃতিতে স্বল্পবাদ ছিলই। কিন্তু সাসাকি দেখিয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে কী ভাবে জাপানের বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সব হারাতে হারাতে জাপানের জীবনযাত্রায় শূন্যতাকেই
পূর্ণতা মনে করার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সাসাকির স্বল্পতাবাদ বাড়তি জঞ্জাল সরানোর থেকেও গুরুত্ব দেয় জীবনে প্রকৃতই যা মূল্যবান তা চিহ্নিত করা। রাবাই হিম্যান শাসতেল-এর একটি চমৎকার ভাবনা ভাগ করে নিয়েছেন সাসাকি। সেখানে বলা হচ্ছে যা চাই তাকে পাওয়াই আনন্দ নয়, যা পেয়েছি তাকে চাওয়াই আনন্দ। রবীন্দ্রনাথও তো বলেছিলেন, “কী পাইনি, তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।”

জাপানের ‘জ়েন’ বৌদ্ধধর্ম শূন্যতা আর স্বল্পতার সাধনার পথই দেখায়, যা এক সময় আচ্ছন্ন করেছিল অ্যাপল-এর কর্ণধার স্টিভ জোবসকে। অ্যাপলের প্রায় সব সরঞ্জামে তাই দেখা যায় স্বল্পতাবাদের ছায়া। সাসাকি মনে করছেন, জাপানে অ্যাপলের জনপ্রিয়তা যেন জাপানের নিজের স্বল্পতাবাদকেই নতুন করে ফিরে পাওয়ার উদাহরণ। গৌতম বুদ্ধের বাণী ও নীতির সঙ্কলন ধম্মপদ বলছে, প্রিয় অথবা অপ্রিয় কিছুর প্রতিই আসক্ত না হওয়ার কথা, কেননা, “প্রিয়ের অদর্শনেও যেমন দুঃখ, অপ্রিয়ের দর্শনেও দুঃখ।” এই অতিমারি কি বহু আসক্তি থেকে দূরে যেতে আমাদের এক রকম বাধ্য করে, কোথাও বেশি জড়িয়ে না পড়ার একটা নেশা আমাদের ধরিয়ে দিয়ে গেল? বলে গেল— বাড়তি কিছুই বিষ, পারলে ফেলে দিস!

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy