অতিমারির বন্দিজীবনে ভীষণ কষ্টে আছে আমাদের সন্তানেরা। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে প্রতি দিন। কখনও আচরণে স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, কখনও ক্ষয় চলছে নিঃশব্দে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা খাচ্ছে না, ঘুমোচ্ছে না, মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতেও তাদের অনীহা। তিন-চার বছরের বাচ্চা অস্থিরতার শেষ নেই, ঘরবন্দি থাকতে থাকতে তাদের অসহিষ্ণুতা চরমে।
ব্রিটেনে ৪-১৬ বছরের প্রায় ২৬৭৩ জন শিশুকে নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়েছে। জানা গিয়েছে, অতিমারিতে অতিচঞ্চলতার হার বেড়েছে ২০%, নেতিবাচক ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৩৫%। নিউ ইয়র্কের সমীক্ষা দেখিয়েছে, এই পরিস্থিতিতে প্রতি তিন কিশোরীর এক জন এবং পাঁচ কিশোরের এক জন দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতার শিকার। ভারতের ত্রিশটি শহরের তথ্যের ভিত্তিতে জানা গিয়েছে, প্রায় ৬৫% শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। তাদের মধ্যে ৫০% বাচ্চা আধ ঘণ্টার বেশি ফোন ছেড়ে থাকতেই পারে না।
ওরা যে ছোটাছুটির রুটিন থেকে হঠাৎই অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটকে পড়েছে চার দেওয়ালের খোপে। প্রাকৃতিক আলোর মধ্যে প্রচুর খেলাধুলো, দৌড়ঝাঁপ ছিল স্বাভাবিক জীবনের অঙ্গ। এতেই সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের (যা বিভিন্ন আচরণের হোতা) পর্যাপ্ত ক্ষরণ হয়, ছোটরা প্রাণবন্ত থাকে। গত দেড় বছর খেলাধুলার সুযোগ, নিয়মিত সূর্যের আলোটুকু গায়ে লাগানোর অভ্যাস নেই। ফলে সেরোটোনিনের ক্ষরণ কমেছে। এবং অশান্ত, আগ্রাসী মনোভাব, ঘুম ও খিদের অভাব বেড়েছে।
আরও বিপদের কথা, স্কুলে যাওয়ার মজাটা কেড়ে নিয়ে পড়াশোনার প্রতি উৎসাহে ঘাটতি এনেছে অতিমারি। স্কুলের প্রস্তুতি, স্কুলবাসে ওঠা, ক্লাস শুরুর আগে হুটোপাটি, পিরিয়ডের ফাঁকে গল্প, টিফিনে ঝটপট খেয়েই দৌড়ে খেলার মাঠে, স্কুলের ঘণ্টা বাজলে আবার হইহই আর খুনসুটি করতে করতে বাড়ি ফেরা— এই গোটা পদ্ধতির মধ্য দিয়েই চলত পড়াশোনা। এক সঙ্গে বোর্ডে কাজ করা বা শ্রুতিলিখন, সবার আগে শিক্ষিকাকে ছুট্টে গিয়ে খাতা জমা দেওয়া, রংপেনসিল আনতে ভুলে গিয়ে শাস্তি— এ সবের মধ্য দিয়েই কচি মনের বিভিন্ন স্তরের গঠন সম্পূর্ণ হত। এখন ওরা মুখ ধুয়ে ঘুমচোখেই বিছানা বা ঘরেরই এক কোণে বসে পড়ছে মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে। নেটসংযোগ ঠিকঠাক থাকলে ভিডিয়োয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখতে পাচ্ছে। না হলে, তাঁদের কথা শুনেই পড়াশোনা চলছে। এতে লেখাপড়া থেকে মন বিমুখ হচ্ছে। পরিকাঠামোর অভাবে অনেকেই নতুন পদ্ধতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে দিনের একটা বড় অংশ তারা বইখাতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের শেখার, অনুশীলনের বা বিশ্লেষণের ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত। অতিমারি কাটিয়ে ওঠার পর হয়তো দেখা যাবে ছাত্রসমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা টিকিয়ে রাখতে পারছে আর বাকিদের জন্য পড়ে রয়েছে অন্ধকারের ভবিষ্যৎ।
সচ্ছল শিশুদের জন্য এক রকম সমস্যা সমাধানের লোভ দেখাচ্ছে অনলাইন দুনিয়া। অভিভাবকেরা দৌরাত্ম্য সামাল দিতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন। অতিমারিতে সেই অভ্যাস বহু গুণ বেড়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওরা মোবাইল স্ক্রিনে ডুবে আছে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে পা দিয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং বা অনলাইন গেমের মোহে। আসক্তি বাড়লেই জীবনযাত্রা এবং ব্যবহারে স্পষ্ট ছাপ দেখা দিচ্ছে। পড়াশোনা অবহেলিত হচ্ছে। স্মার্টফোনের বিনোদন একাই উপভোগ্য। তাই অনেক সময়ই বয়সোচিত না হলেও শিশুর কাছে তা সহজলভ্য। ক্রমে বিনোদনের প্রতি ওরা তীব্র টান অনুভব করছে এবং মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটারটির ক্ষরণ হচ্ছে। ফলে লেখালিখি, অঙ্ক করা বা নিবিষ্ট মনে পড়াশোনার কাজ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ মস্তিষ্ক তখন শুধুই লঘু বিনোদনমূলক বিষয়ের দিকে আগ্রহী থাকে। বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। সেটুকু শ্রমেও মস্তিষ্ক নারাজ। ক্রমে আন্তর্জালেই বেশির ভাগ সময় দিয়ে দেয় তারা। নষ্ট হতে থাকে জ্ঞান আহরণের বা সামাজিক হয়ে ওঠার গুণাবলি। কিশোর-অপরাধের প্রবণতাও অলীক নয়।
তবে কি তিলে তিলে ফুরিয়ে যাবে ওদের সম্ভাবনা? সমাজরক্ষকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। টিকাকরণে গতি এনে শিক্ষালয়গুলো খোলার ব্যবস্থা হোক অবিলম্বে। উন্নত দেশ বাচ্চাদের মানসিক সুস্বাস্থ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে বিভিন্ন উপায় ভাবছে। ব্রিটিশ প্রশাসন অভিভাবকদের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করতে বলেছে। খেলা ও শখের সময় আলাদা করা, সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত করা, দৈনিক এক ঘণ্টা শারীরিক কসরত, নিয়ম মেনে ঘুম, পুষ্টিকর খাবারের দিকে লক্ষ রাখা। অভিভাবকেরাও শিশুদের স্বার্থে নিজেদের কাজের পদ্ধতি বদলানোর চেষ্টা করছেন।
আমাদেরও এ ভাবেই উদ্যোগী হতে হবে। বাড়িতে সুস্থ পরিবেশে ওদের বড় করে তুলুন। ওদের সঙ্গ দিন, সার্বিক বিকাশে নজর রাখুন। আর গ্যাজেটমুক্ত পারিবারিক সময় কাটানোর সুঅভ্যাস গড়ে তুলুন। জীবনযাত্রায় একটু সারল্য আর নিয়মের ভারসাম্যে ওদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারলে, হয়তো অতিমারির বয়ে আনা সমস্যাগুলো থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy