Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
ঘরের কাছেই সর্প-রাজত্ব
afganistan

দুই দশকে তালিবান একটুুও পাল্টায়নি, দ্রুত প্রমাণ মিলছে

গণতন্ত্রবিরোধী, নারীবিদ্বেষী ও প্রাচীন মতাদর্শে বিশ্বাসী তালিবানের পুনরুত্থান যে পৃথিবীর মানুষকে বিচলিত করেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আতঙ্করাজ: হাজার হাজার মানুষ পালাতে চাইছেন যখন, বিমানবন্দর পাহারা দিচ্ছে তালিবান যোদ্ধারা, কাবুল, ১৬ অগস্ট।

আতঙ্করাজ: হাজার হাজার মানুষ পালাতে চাইছেন যখন, বিমানবন্দর পাহারা দিচ্ছে তালিবান যোদ্ধারা, কাবুল, ১৬ অগস্ট। পিটিআই।

সুমিত মিত্র
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২১ ০৫:৪৮
Share: Save:

আফগানিস্তানে তালিবানের ঝটিকা বিজয়ে আতঙ্কিত অনেকেই। আতঙ্ক অকারণ নয়। রাজধানী কাবুল-সহ সমগ্র দেশটি কয়েক দিনের মধ্যে কুক্ষিগত করে টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে যদিও তালিবানের নেতারা বলছেন, “ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না”— তবু সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। এরই মধ্যে বামিয়ান প্রদেশে তালিবানেরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাজারা সম্প্রদায়ের নেতা আব্দুল আলি মাজারির মূর্তি; মাজারিকে তালিবান আততায়ীরা হত্যা করেছিল ১৯৯৫-এ। এই মূর্তি-ধ্বংসটিই প্রমাণ যে, গত দুই দশক ক্ষমতার বাইরে থেকেও কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি তালিবান মানসিকতায়। তারা, ইউরোপের বুরবোঁ রাজাদের মতো, না করবে মাফ, না ভুলবে পুরনো ক্ষত।

গণতন্ত্রবিরোধী, নারীবিদ্বেষী ও প্রাচীন মতাদর্শে বিশ্বাসী তালিবানের পুনরুত্থান যে পৃথিবীর মানুষকে বিচলিত করেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে মানুষ যা দেখে হতবাক তা হল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পলায়নপ্রবণতা। ২০০১ সালে তাঁর পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে নিউ ইয়র্কে আতঙ্কবাদীদের আত্মঘাতী বিমানহানার পর যখন বোঝা যায় এই আক্রমণের হোতা ওসামা বিন লাদেন রয়েছেন আফগানিস্তানের তালিবানের আশ্রয়ে, তৎক্ষণাৎ আমেরিকা সৈন্য নামায় সেই দেশে, এবং তাদের প্রবল আক্রমণের চোটে চম্পট দেয় তালিবান। তার পর কুড়ি বছর তিল তিল করে গড়ে ওঠে এক গণতন্ত্রমুখী আফগানিস্তান। মাদ্রাসার পাশাপাশি বিস্তার হয় আধুনিক শিক্ষার। গুটিপোকা থেকে প্রজাপতির মতো, বোরখা ও চাপদাড়ির আস্তরণ থেকে বেরিয়ে আসে অসংখ্য সাধারণ মানুষ। শ্রমিক বা ড্রাইভার থেকে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার বা বিচারক— এক প্রজন্মতেই আফগান মানুষ খুঁজে পায় জীবন ও জীবিকার বৈচিত্র।

তখনও কিন্তু নবোদ্গত গণতন্ত্রের প্রহরার প্রয়োজন ছিল। দরকার ছিল আমেরিকান সেনার উপস্থিতির, যতই তা কম সংখ্যায় হোক, কারণ তাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বিনা সম্ভব নয় তালিবান জঙ্গিদের প্রতিরোধ করা। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে বিশেষত মধ্য আমেরিকায় দেখা দিচ্ছিল এক বিচ্ছিন্নতার ঝোঁক। তারই চাপে ট্রাম্প জমানাতেই গত বছর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ট্রাম্প শশব্যস্ত হয়ে পড়েন যে কোনও মূল্যে আমেরিকান সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে। তিনি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বাইডেনকে ঘিরে নতুন আশার সঞ্চার হচ্ছিল যে, দুম করে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে এসে তিনি হয়তো এই নবীন গণতন্ত্রটিকে বলিতে চড়াতে আগ্রহী হবেন না। আশাটি নিরর্থক। বিদেশি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে ভোঁ-দৌড় দিতে বাইডেন যে ট্রাম্পের চেয়ে কম উৎসাহী নন, এবং তিনি যে তার জন্য প্রকৃত সত্য গোপন করতেও প্রস্তুত, তা বোঝা গেল ৮ জুলাই এক প্রেস কনফারেন্সে তাঁর বক্তব্য থেকে। প্রশ্ন ছিল, “এখন কী মনে হচ্ছে যে তালিবানের আফগানিস্তান বিজয় অবধারিত?” উত্তর, “নাহ্, তা নয়।” প্রশ্ন, “কেন?” উত্তর, “কারণ আফগানিস্তানের আছে তিন লক্ষ আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্য, এবং বিমানবহর। আর প্রতিপক্ষ হল পঁচাত্তর হাজারের তালিবান বাহিনী। ফলে তালিবানের বিজয় মোটেই অবধারিত নয়।”

আশ্চর্য, বাইডেনের এই উক্তির ঠিক ৩৮ দিন পরে টেলিভিশনে দেখা গেল, কাবুলে ঝড়ের মতো প্রবেশ করছে তালিবান যোদ্ধারা এবং আকাশে সন্ত্রস্ত পাখির মতো উড়ছে একের পর এক হেলিকপ্টার, আমেরিকান দূতাবাস কমপ্লেক্স থেকে তার কর্মচারীদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে। কাবুলের পরিস্থিতি কতটা আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে, তা বাইডেন হয় খবর রাখেননি, নয় সত্যটি চেপে রাখছিলেন। এই দুইয়ের কোনওটিই তাঁর পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৫ সালের তরুণ সেনেটর জো বাইডেন সংক্রান্ত একটি তথ্য। ৩২ বছরের সেনেট সদস্য জরুরি তলব পেয়েছিলেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের কাছ থেকে, হোয়াইট হাউসে ভিয়েতনাম সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য। সেই আলোচনাতেও নাকি এই নবীন সেনেটর অন্য অভ্যাগতদের উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্টকে বলেন, ভিয়েতনামে আমেরিকার পরিস্থিতি একদম ‘হোপলেস’, এবং সরকারের আশু কর্তব্য হল যত শীঘ্র সম্ভব সেখান থেকে সরে আসা। ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যাবর্তন সমর্থনকারী অন্য যে কয়েক জন সেনেটর সেই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন তাঁরা নাকি বলেছিলেন, বাইডেনের বক্তব্য ছিল ‘ডাইড্যাকটিক’ (শিক্ষকসুলভ)।

রাজনৈতিক পতাকার রঙে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন পরস্পরের বিপরীত হলেও একটি ব্যাপারে তাঁদের কোনও পার্থক্য নেই। তা হল, রাজনৈতিক স্বার্থপরতা। মিলিটারি খরচ কমানোর আনন্দে ট্রাম্পের মতোই বাইডেন ছিলেন এতই মশগুল যে, লক্ষ করেননি— তালিবান মোটেই গত বিশ বছরে পাল্টায়নি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। গত মে মাসে তারা স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীদের উপর গুলি বর্ষণ করে; নিহত হয় নব্বইটি মেয়ে। জুন মাসে যখন একদল আফগান সেনা তালিবানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যায়, তখন তাদের উপর আচমকা গুলি চালিয়ে খুন করা হয় বাইশ জনকে। জনমানসে এত দিনে নিশ্চয় স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছে— তালিবান এক দানবিক শক্তি, যা এই মুহূর্তে কাবুলের আমির-তখ্‌তে আসীন। তার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, আফগানিস্তানের ১.৮ কোটি নারীর আবার ফিরে যেতে হবে ইসলামি শাসনে। এবং সেই শাসন কায়েম করবে যারা, তাদের নারী জাতি সম্পর্কে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা অন্তহীন।

তা ছাড়া, কেবল নিরাপত্তার বিচারেও বাইডেন কর্তব্যচ্যুতি করেছেন। যাঁরা এখন সে দেশে শীর্ষ পদে সমাসীন, তাঁদের অনেকেই দাগি অপরাধী। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মোল্লা আব্দুল গনি বরাদর, তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের বিশেষ প্রিয়পাত্র, যিনি ২০১০ থেকে আট বছর করাচিতে জেলখাটার পর ট্রাম্পের অনুরোধে ছাড়া পেয়ে আমেরিকার সঙ্গে তালিবানের অলিখিত সন্ধিপ্রস্তাবের বিশেষ প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। এই লেখকের এক কূটনীতিক বন্ধুর মতে, বরাদর হচ্ছেন ‘তালিবানের কিসিঞ্জার’। আছেন মিলিটারির প্রধান মোল্লা মহম্মদ ইয়াকুব, যিনি মরহুম নেতা মোল্লা ওমরের পুত্র। তবে তালিবানের লড়াকু চরিত্রকে যিনি এক বৈশ্বিক উৎপাতে পরিণত করতে পারেন, তিনি হলেন তালিবানের উপপ্রধান সিরাজুদ্দিন হক্কানি। সোভিয়েট-বিরোধী যুদ্ধের প্রধান নায়ক জালালুদ্দিন হক্কানির পুত্র সিরাজুদ্দিন এফবিআই-এর ‘মোস্ট ওয়ান্টেড টেররিস্ট’দের এক জন। তাঁকেই মনে করা হয় আল কায়দা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ইসলামি আতঙ্কবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তালিবানের প্রধান সেতু।

এশিয়ার কেন্দ্রস্থানে এই সাপের গর্ত অনাচ্ছাদিত রেখে মঞ্চ থেকে সবেগে প্রস্থান করে বাইডেন গণতন্ত্রপ্রিয় পৃথিবীতে সম্পূর্ণ পাল্টে দিলেন হোয়াইট হাউস সম্পর্কে ধারণা। জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জ়িল্যান্ডের মতো যে সব দেশ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য পরোক্ষ ভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল, তারা এখন চিনের দিকে তাকালেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। ও দিকে তালিবানের ভয়ে পলাতক অন্য দেশে নতুন অভিবাসীদের ধাক্কায় ইউরোপ জুড়ে শুরু হবে এক নতুন জাতীয়তাবাদী ঝঞ্ঝা, যার পরিণতিতে পশ্চিমের রাজনীতির মুখ হয়ে উঠবেন হাঙ্গেরির নেতা ভিক্টর ওবানের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদীরা।

তবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের অবস্থা হতে পারে আরও করুণ। আমেরিকার এই স্বার্থসর্বস্ব মূর্তি দেখে ধরা পড়বে যে, ওয়াশিংটন থেকে চিনের আগ্রাসন— কোনও রেহাই মিলবে না। অপরপক্ষে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্ররোচনায় (যেমন, আফগানিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখ শরণার্থী স্বাগত) ভারত যত হয়ে পড়বে ‘হিন্দু তালিবান’-এর আখড়া, ততই রুদ্র রূপ ধারণ করবে দেওবন্দি তালিবানের উষ্মা। ভারতে সাম্প্রদায়িক কলহ তখন হয়তো আর এতটা একপেশে থাকবে না। সংখ্যালঘুদের লাঠিপেটায় সিদ্ধহস্ত গোরক্ষকরা হয়তো আগের মতো কাজে আসবে না। আফগান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আমেরিকার অন্তর্ধান পর্ব শেষ। এ বার আক্রমণাত্মক আফগানিস্তান ও আত্মপ্রত্যয়ী পাকিস্তানের সামনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীর আত্মসমীক্ষার সময়।

অন্য বিষয়গুলি:

afganistan taliban
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy