ভারত ‘না’ বলিয়াছে। ওজনদার ‘না’। কারণ, তাহার লক্ষ্যবস্তুটি আমেরিকা স্বয়ং। এশিয়া-সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতকে সঙ্গী করিয়া যৌথ নজরদারির প্রস্তাব দিয়াছিল আমেরিকা। প্রকৃতপক্ষে চিনকে চাপে রাখিবার প্রস্তাব। দক্ষিণ চিন সাগরের উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করিলে প্রস্তাবটির গুরুত্ব বড় কম নহে। এই অঞ্চলে চিনের প্রতিপত্তি বিপুল ভাবে বাড়িয়াছে। আস্ফালনও। গত বৎসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর-কালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং এই অঞ্চলের দ্বীপগুলির সামরিকীকরণ না করিবার আশ্বাস দিয়াছিলেন। সেই আশ্বাস যে অসার, ইতিমধ্যেই তাহা প্রমাণিত— চিন সেখানে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করিয়াছে এবং অস্ত্র সাজাইতেছে। এমতাবস্থায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতকে দলে টানিবার চেষ্টা করিবে, তাহা প্রত্যাশিতই ছিল। তাহাই হইয়াছে। কিন্তু ভারত এই প্রস্তাবে সম্মত হয় নাই। এবং আগামী দিনে চিন-বিরোধী আলোচনাতেও যে সে অংশ লইবে না, তাহাও বিদেশ মন্ত্রক স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়াছে।
অসম্মতির কারণ কী? এশিয়ার সমুদ্রে মহামহিম আমেরিকার কল্যাণহস্ত ধরিবার সৌভাগ্য এবং জাপান-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিত্রতা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে ভারতকে উত্তর-পূর্বের পাহাড়ে বাড়তি অক্সিজেন জোগাইত। সেই সুযোগ ভারত হাতছাড়া করিল কেন? উত্তর রহিয়াছে কূটনীতির চরিত্রেই। আপাত-সুবিধা এবং সামগ্রিক স্বার্থের মধ্যে প্রায়শই বিস্তর ব্যবধান থাকে। এই কারণেই কূটনীতির পথ জটিল, সচরাচর গোলকধাঁধার মতো। দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের শক্তিবৃদ্ধি যদি সরাসরি কোনও দেশের স্বার্থে আঘাত হানিয়া থাকে, তাহার নাম আমেরিকা, ভারত নহে। ‘আন্তর্জাতিক আইন’ মোতাবেক দক্ষিণ চিন সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের অবাধ স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার কথা বলিয়া আমেরিকা সেখানে চিনকে সংযত রাখিতে তৎপর। ভারতকে সঙ্গী পাইলে তাহার আন্তর্জাতিকতাবাদের অজুহাতটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। কিন্তু ভারত তাহার সহিত গাঁটছড়া বাঁধিবে কেন? প্রশান্ত মহাসাগর লইয়া এখনই তাহার উদ্বিগ্ন হইবার কিছু নাই। বরং, এই জোটের অংশী হইলে সমস্যাবৃদ্ধির সম্ভাবনাই প্রবল। এক, চিনের রোষ উৎপাদনের সমস্যা। দুই, আমেরিকার তাঁবেদার হইবার সমস্যা। এমতাবস্থায় নিজের নিরপেক্ষ অবস্থানটি স্পষ্ট করিতে আমেরিকাকে একটি ‘কড়া’ বার্তা দিবার প্রয়োজন ছিল।
তবে এই বার্তা হয়তো শুধুমাত্র লাভ-ক্ষতির অংক কষিবার পরিণাম নহে, অন্তর্নিহিত অভিমানের প্রকাশও। সেই অভিমানের জন্য প্রধানত দায়ী পাকিস্তান (ও চিন) সম্পর্কে আমেরিকার নীতি। ভারতের মাটিতে পাক-সন্ত্রাস লইয়া মৌখিক আশ্বাস দিলেও তাহা বন্ধ করিবার জন্য ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির উপর আমেরিকা যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে নাই। বরং আফগানিস্তান এবং তালিবান প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতি নরম মনোভাবই প্রদর্শন করিয়াছে। এবং, এই কাজে পাকিস্তানকে বশে রাখিবার তাগিদে তাহারা বেজিংকেও পাশে চায়! চিন সম্পর্কে ওয়াশিংটনের এই ‘দ্বিচারিতা’ ভারতের সুনজরে দেখিবার কারণ নাই। সুতরাং, ভারতের সাহায্য পাইতে হইলে আমেরিকাকে ভারতের স্বার্থ দেখিতে হইবে এবং তাহার এশিয়া নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন ঘটাইতে হইবে। ওয়াশিংটন যদি সেই পথে হাঁটিয়া নয়াদিল্লির অভিমান ভাঙাইতে যত্নশীল হয়, তবে ভবিষ্যতে ভারতের ‘না’ যে ‘হ্যাঁ’ হইবে না, তাহা কে বলিতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy