অজান্তে অবসরের তহবিল তৈরি হয় বলেই সম্ভবত সঞ্চয়ের দুনিয়ায় এত কদর কর্মী প্রভিডেন্ট ফান্ডের (ইপিএফ)। কিন্তু ওই খাতে টাকার পুরোটাই কি পরে এক লপ্তে পাওয়া যাবে? তাহলে পিএফে পেনশনের ব্যাপারটা কি? ঋণ, বিমার মতো আরও কিছু সুবিধাও না কি রয়েছে এতে। এ সবই আমরা অনেকে জানি। অনেকে জানি না। অনেকের আবার জানলেও পুরো ধারণা স্বচ্ছ নয়। তাই আজ এ সব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা বসব আমরা।
কর্মী প্রভিডেন্ট ফান্ড
পুরো নাম এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড (ইপিএফ)। যে সমস্ত সংস্থায় কর্মী সংখ্যা ২০ বা তার বেশি, সেখানে এই প্রকল্প থাকা বাধ্যতামূলক। ভারতীয় কর্মী ছাড়াও এ দেশের সংস্থায় কর্মরত বিদেশি কর্মীরাও এই সুবিধা পান। কর ছাড়ের সুবিধা থাকায় এই প্রকল্প অবসরের তহবিল গড়ার পক্ষে ভাল।
লগ্নি কী ভাবে?
• প্রতি মাসে মূল বেতনের ১২% টাকা এই খাতে দেন কর্মীরা। একই অঙ্কের টাকা দেন নিয়োগকারী। বিড়ি, চটের মতো কিছু শিল্পে তা ১০%।
• সংস্থার দেওয়া ১২% টাকার অবশ্য পুরোটা ইপিএফ খাতে জমা হয় না। এর মধ্যে —
l ৩.৬৭% যায় পিএফ খাতে।
l বাকি ৮.৩৩% যায় এমপ্লয়িজ পেনশন প্রকল্পে (ইপিএস)।
• নিয়ম অনুসারে সংবাদপত্র, প্রতিরক্ষার মতো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সমস্ত সংস্থায় ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত মূল বেতনের উপরে পেনশনের হিসেব করা হয়। অর্থাৎ, আপনার মূল বেতন যা-ই হোক, পেনশন খাতে সর্বোচ্চ জমা হবে {(৮.৩৩/১০০)x১৫,০০০}= ১,২৫০ টাকা।
উদাহরণ
ধরা যাক কোনও কর্মীর মূল বেতন ২০,০০০ টাকা। সে ক্ষেত্রে—
• তিনি পিএফ খাতে জমা দেবেন মূল বেতনের ১২%, অর্থাৎ ২,৪০০ টাকা।
• সংস্থাও তাঁর হয়ে ওই অঙ্কই জমা দেবে। কিন্তু সেখান থেকে ৮.৩৩% বা ১,২৫০ টাকা যাবে পেনশন খাতে।
এখানেও দেখবেন, আসলে পেনশন খাতে বেশি টাকা যাওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু ১৫,০০০ টাকার উপরে তার হিসেব হবে, তাই সর্বোচ্চ ১,২৫০ টাকাই গিয়েছে পেনশনে।
• আর বাকি (২,৪০০-১,২৫০)= ১,১৫০ টাকা যাবে পিএফ খাতে।
অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ওই কর্মীর পিএফ খাতে প্রতি মাসে জমা পড়বে ২,৪০০+১,১৫০=৩,৫৫০ টাকা।
অতিরিক্ত জমা
নির্দিষ্ট অঙ্ক ছাড়াও, প্রতি মাসে অতিরিক্ত টাকা পিএফে কাটানোর সুযোগ রয়েছে। যার সর্বোচ্চ অঙ্ক হতে পারে মূল বেতনের ৮৮% পর্যন্ত। এই টাকা একমাত্র কর্মীই জমা দেন। নিয়োগকারী তা দিতে বাধ্য নন। এ ভাবে বাড়তি টাকা কাটানোর সুবিধা হল, এই জমা কর্মীর আসল পিএফের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং এ থেকে সুদও মেলে পিএফের হারে। তার উপর সেই সুদ আবার পুরোপুরি কর মুক্ত।
টাকা খাটে কোথায়?
আগে শুধু ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পগুলিতে পিএফের টাকা খাটানো হত। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই ছবি বদলেছে। এখন নতুন জমার ১৫% পর্যন্ত খাটে শেয়ার বাজারে। ইটিএফ মারফত।
কর ছাড়
এই প্রকল্পের সুবিধা হল, এতে থাকা কর ছাড়ের সুযোগ। কী কী সুবিধা রয়েছে, চলুন দেখি—
• আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় ইপিএফে প্রতি অর্থবর্ষে জমা দেওয়া কর্মীর অংশের টাকার উপরে করছাড় মেলে। বছরে যার সর্বোচ্চ অঙ্ক ১.৫০ লক্ষ টাকা।
• বছরে নিয়োগকারীর দেওয়া টাকাতেও কর ছাড়ের সুযোগ রয়েছে।
• কর্মী ও নিয়োগকারীর জমা দেওয়া টাকার উপরে বছরে পাওয়া সুদও (২০১৭-১৮ সালে যা ৮.৫৫%) পুরোপুরি কর মুক্ত।
• চাকরি থেকে অবসর অথবা চাকরি ছাড়ার সময়ে পিএফ খাতে পাওয়া পুরো টাকা করমুক্ত। তবে সে ক্ষেত্রে ৫ বছরের বেশি চাকরি করতে হবে।
টাকা তোলা
নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে পিএফ থেকে টাকা তোলা যায়। এর মধ্যে রয়েছে—
• বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনা, নিজের ও সন্তানের পড়াশোনা, নিজের বা সন্তানের বিয়ে, চিকিৎসা খরচ ইত্যাদি।
• তবে সব ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত টাকা তোলা যায়।
• কত টাকা তোলা যাবে, তা নির্ভর করে বেতন, কত দিন চাকরি করেছেন ইত্যাদির উপরে।
পিএফের পেনশন
প্রকল্পটির পুরো নাম এমপ্লয়িজ পেনশন স্কিম (ইপিএস)। আগেই বলেছি, ইপিএফ খাতে কেটে নেওয়া টাকার একটা অংশ (সর্বোচ্চ ১,২৫০ টাকা) প্রতি মাসে জমা পড়ে এই প্রকল্পে। কর্মীদের এ জন্য আলাদা করে কিছু দিতে হয় না। পুরোটাই দেয় নিয়োগকারী সংস্থা। এ ছাড়াও কেন্দ্র বেতনের ১.১৬% জমা দেয় এই খাতে। ৫৮ বছর বয়স হলে (কিছু ক্ষেত্রে ৫০ বছর) এই খাতে জমা হওয়া টাকা থেকেই পেনশন পান কর্মীরা।
বৈশিষ্ট্য
• এই প্রকল্পে আলাদা করে নাম দিতে হয় না। ইপিএফের সদস্য হলেই এখানে টাকা রাখা যায়।
• ইপিএসে নিয়োগকারী বা কেন্দ্রের জমা দেওয়া টাকার উপরে কোনও সুদ পাওয়া যায় না। যতটা টাকা জমা হয়, তা থেকেই প্রতি মাসে পেনশন মেলে।
• পেনশন পেতে গেলে কমপক্ষে ১০ বছর চাকরি করতে হয়।
• এমনিতে ৫৮ বছর বয়স হলেই পেনশনের জন্য আবেদন করা যায়। অর্থাৎ সেই কর্মী তার পরে চাকরি করলেও, ৫৮ বছর থেকেই তাঁর পেনশন চালু হয়। ৫৮ বছর হওয়ার আগে চাকরি ছাড়লেও, ওই দিন থেকে পেনশন পাবেন। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ৫০ বছরেও পেনশন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তার আগে কোনও ভাবেই পেনশন মেলে না।
• কর্মী যত দিন বেঁচে থাকেন, তত দিন ওই পেনশন তো পাওয়া যায়ই। তাঁর মৃত্যু হলেও টাকা পান স্ত্রী এবং নির্ভরশীল সন্তান (সর্বাধিক দু’জন)।
• সর্বোচ্চ ৭,৫০০ টাকা পেনশন মেলে। ন্যূনতম অঙ্ক ১,০০০ টাকা।
• কোনও কর্মী সাড়ে ন’বছরের আগে চাকরি ছেড়ে দিলে, তিনি পেনশন খাতে জমা টাকা ফেরত পান। মোট কত টাকা পাবেন, তা স্থির হবে তাঁর বেতন ও চাকরির মেয়াদের উপর ভিত্তি করে। আর সাড়ে ন’বছরের পরে কিন্তু ১০ বছরের আগে চাকরি ছাড়লে, পেনশন হিসেব করার সময়ে চাকরির মেয়াদ ১০ বছরই ধরা হবে। ফলে তখন তিনি পেনশনের যোগ্য।
• পেনশনের জন্য চাকরির সর্বোচ্চ মেয়াদ ধরা হয় ৩৫ বছর।
• যদি কেউ এই সময়ের মধ্যে কিছু দিন বা বছর চাকরি না করেন, সে ক্ষেত্রে মোট মেয়াদের থেকে তা বাদ যায়। যা বাকি থাকে, তার উপর ভিত্তি করে পেনশনের অঙ্ক স্থির হয়।
• শর্ত সাপেক্ষে ৫০ বছরের পরে এবং ৫৮ বছরের আগেও অগ্রিম পেনশনের জন্য আবেদনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে যত দিন না ৫৮ বছর হচ্ছে, তত দিন প্রতি বছরে ৪% করে কম পেনশন মিলবে। তবে মৃত্যু বা শারীরিক ভাবে অক্ষম হলে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
• কোনও কর্মী ইপিএসের আওতায় একাধিক পেনশন পাওয়ার যোগ্য নন। যদি অনেক সংস্থায় কাজ করেন, তা হলে সমস্ত পেনশনকে এক ছাতার তলায় এনে তার পরে পেনশনের আবেদন করতে হবে।
• এই পেনশন করযোগ্য। বেতন খাতে আয়ের মধ্যে এর অঙ্ক যোগ করে করের হিসেব হবে।
হিসেব কী ভাবে?
যাঁরা ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বরের আগে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে পেনশন হিসেবের নির্দিষ্ট ফর্মুলা রয়েছে। কিন্তু তা বেশ জটিল। আর যাঁরা তার পরে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের জন্য ওই পেনশন স্থির করার ফর্মুলা হল—
পেনশন= (গড় বেতন x চাকরির মেয়াদ)/ ৭০
এ ক্ষেত্রে গড় বেতনের অর্থ পেনশন দেওয়ার জন্য ধার্য করা টাকা। ২০১৪ সালের ৩১ অগস্ট পর্যন্ত যার সর্বোচ্চ অঙ্ক ৬,৫০০ টাকা। আর ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫,০০০ টাকা।
ইপিএফে বিমা
ইপিএফের আওতায় শুধু পিএফের টাকা বা পেনশনই মেলে না। তার সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে রয়েছে বিমার সুবিধাও। এর নাম এমপ্লয়ি ডিপোজিট লিঙ্ক ইনশিওরেন্স স্কিম। এর আওতায় চাকরি করার সময়ে কোনও কর্মীর মৃত্যু হলে নির্দিষ্ট অঙ্কের থোক টাকা পান তাঁর নমিনি।
বিমার অঙ্ক
আগে কেউ টানা এক বছর একই সংস্থায় কাজ করলে, এই বিমার সুবিধা পেতেন। সে ক্ষেত্রে শেষ ১২ মাসের গড় মূল বেতনের (বেসিক এবং ডিএ) ২০ গুণ এবং তার সঙ্গে ২০% মিলত। এ ক্ষেত্রে মূল বেতনের সীমা ১৫,০০০ টাকা। ফলে বিমার সর্বোচ্চ অঙ্ক দাঁড়াত ৩.৬ লক্ষ টাকা।
কিন্তু ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ইপিএফ কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ বিমামূল্য বাড়িয়ে ৬ লক্ষ টাকা করার কথা ঘোষণা করেন। স্থির হয়, কর্মী শেষ যে মূল বেতন পাবেন, তার ৩০ গুণ বিমা পাবেন তিনি। দেওয়া হবে ১.৫ লক্ষ টাকার বোনাসও। একই সঙ্গে এক বছর চাকরির শর্তও তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কারও মূল বেতন যদি ১৫,০০০ টাকা হয়, তার ৩০ গুণ বিমা মানে ৪.৫ লক্ষ টাকা। তার সঙ্গে যোগ হবে ১.৫ লক্ষের বোনাস। সব মিলিয়ে বিমার অঙ্ক দাঁড়াবে ৬ লক্ষ।
যদি বেতন ১৫,০০০ টাকা না হয়, সে ক্ষেত্রে তাঁর শেষ বেতন ধরেই বিমার হিসেব হবে।
কর ছাড়
এই বিমার টাকা পুরোটাই করমুক্ত। নমিনিকে কোনও কর দিতে হবে না।
প্রিমিয়াম কী ভাবে?
বিমার প্রিমিয়ামের পুরো টাকাই দেয় নিয়োগকারী সংস্থা। সংস্থার নিজস্ব জীবন বিমা না থাকলে, যার অঙ্ক মাসে মূল বেতনের (সর্বোচ্চ ১৫,০০০ টাকা) ০.৫%। কর্মীকে কোনও টাকা এর জন্য দিতে হয় না।
লেখক কর ও বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
পরামর্শের জন্য লিখুন:
‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।
ই-মেল: bishoy@abp.in
ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy