ধীরে ধীরে বড় আকার নিচ্ছে ইজ়রায়েল-হামাসের সংঘাত। ছবি: রয়টার্স।
ছ’বছর হল স্বামী সোমোদয় হাজরার সঙ্গে ইজ়রায়েলে এসেছি। ইজ়রায়েলের উত্তরে হাইফা শহরে। আমি আর সোমোদয় দু’জনেই টেকনিয়ন ইজ়রায়েল আইআইটিতে স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায় যুক্ত। সাড়ে তিন বছর হল আমাদের এক কন্যাসন্তানও হয়েছে। সব ভাল চলছিল। ইজ়রায়েল খুব সুন্দর দেশ। কিন্তু হঠাৎ সব ওলটপালট হয়ে গেল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এই দেশে।
রকেট হানা বা হামাসের আক্রমণের কথা আগেও শুনেছি। কিন্তু হঠাৎ উদ্ভূত যুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের কাছে এই প্রথম। এ রকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আগে দেখিনি। সীমান্ত পেরিয়ে হামাস জঙ্গিরা ঢুকে ঘরে ঘরে গিয়ে ইজ়রায়েলের মানুষকে খুন করছে। মহিলা এবং শিশুদেরও রেয়াত করা হচ্ছে না। জনসমক্ষে মেরে ফেলা হচ্ছে। কী নৃশংস! কী ভয়াবহ! এস্কেলন, আশদোদ শহরগুলি ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তেল আভিভ, বীর সেবা, রিহোভোতে মুহুর্মুহু রকেট হানার খবর পাচ্ছি। ওই সব শহরেও আমাদের পরিচিতেরা রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। প্রচণ্ড আতঙ্ক এবং উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। টিভি এবং সমাজমাধ্যমে সব সময় যুদ্ধের খবর। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। সেই আতঙ্ক গ্রাস করেছে আমাদেরও।
আমরা যেখানে রয়েছি, সেই হাইফা শহর এখনও কিছুটা শান্ত। তবে শুনছি যে, যুদ্ধ ধীরে ধীরে আমাদের দিকেও এগিয়ে আসছে। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে কত দিন ভাল থাকব জানি না। আগে শুধু হামাস হামলা চালাচ্ছিল। এখন লেবানন এবং সিরিয়া থেকেও হামলা চালানো হচ্ছে। এই যুদ্ধ বড় আকার নিয়েছে। আরও বড় আকার নিলে কী হবে, ভেবেই ভয় লাগছে। সব সময় মনে হচ্ছে, এই বুঝি সাইরেনের আওয়াজ ভেসে এল। রাতে ঘুম উড়ে গিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধের খবর রাখছি। সাইরেন বাজলেই বাঙ্কারে ঢুকে যেতে বলা হয়েছে। ৭২ ঘণ্টার জন্য জল, খাবার এবং পোশাক মজুত করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
যুদ্ধ শুরুর পর হাইফা শহরে যানবাহন চলাচল কম গিয়েছে। দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। আমরা কিছু খাবার, জল এবং ওষুধ মজুত করে রেখেছি। কিন্তু সেই জোগানও আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। ইজ়রায়েল সরকার এবং আমাদের গবেষণাকেন্দ্র থেকে সারাক্ষণ বিভিন্ন ভাবে সতর্ক করা হচ্ছে। আমাদের অধ্যাপক, সহকর্মী এবং বন্ধুরা প্রতি মুহূর্তে আমাদের খবর নিচ্ছে। আশ্বস্ত করছে। ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গেও আমরা প্রতি দিন যোগাযোগ রাখছি। অতি প্রয়োজনীয় জিনিস, পাসপোর্ট এবং টাকা নিয়ে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। যাতে প্রয়োজনে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারি। হেল্পলাইন নম্বরও চালু করেছে যাতে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারি। ওরাই এখন আমাদের বড় ভরসা।
তবে সব থেকে মুশকিলে পড়েছি মেয়ে সিন্ধুরাকে নিয়ে। ও সব সময় এটা-ওটা জিজ্ঞাসা করে চলেছে। যুদ্ধের বিষয়ে আমরা এখন থেকেই ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চাইছি না। ওকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাখা হয়েছে।
আমাদের মতোই উদ্বেগ আর আতঙ্কে দিন কাটছে উত্তরপাড়ায় এবং আগরপাড়ায় থাকা আমাদের বাবা-মায়েদেরও। বন্ধুবান্ধবরাও চিন্তায় রয়েছে। ১৪ অক্টোবর অবধি এয়ার ইন্ডিয়া ইজ়রায়েলের সমস্ত বিমান বাতিল করেছে। এই মুহূর্তে দেশে ফেরারও কোনও উপায় নেই। ভারতীয় দূতাবাসের তরফেও আমাদের দেশে ফেরানোর কোনও কথা জানানো হয়নি। এখানে আমাদের মতো অনেক ভারতীয়ই চাইছেন দেশে ফিরে যেতে। তবে বুধবার রাতে খবর পেয়েছি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইজ়রায়েলে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধার করতে ‘অপারেশন অজয়’ শুরু করার পরিকল্পনা করছে মোদী সরকার। বিমান পাঠিয়ে এখানে আটকে থাকা ভারতীয়দের দেশে ফেরানো হবে। তবে আমরা কবে ফিরব জানি না। মাঝেমধ্যেই অজানা আতঙ্কে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাড়ির কথা, উত্তরপাড়ার কথা, আগরপাড়ার কথা, বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।