Pahalgam Terror Attack

মৃতদেহের ধর্ম ঘিরে রাজনীতির নতুন রূপ দেখছে পশ্চিমবঙ্গ, পহেলগাঁও কাণ্ড ঘিরে ভোটের আগের বছরে মেরুকরণ তীব্র

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ে জঙ্গি হামলা হয়েছিল। সেই ঘটনার পরে ‘জাতীয়তাবাদী আবেগ’ কাজ করেছিল। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি ধর্ম যাচাই করে খুন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিহতদের আত্মীয়রা। যা অতীতের অন্য জঙ্গি হামলার সঙ্গে এই ঘটনার মৌলিক পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:০২
West Bengal is witnessing a new form of religious polarization in Politics

পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত পর্যটকেরা (উপরে) মণীশরঞ্জন মিশ্র, সমীর গুহ, (নীচে) বিতান অধিকারী এবং ভারতীয় সেনার প্যারাকমান্ডো ঝন্টু আলি শেখ। —ফাইল চিত্র।

বাংলার রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ গত কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়েছে। ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ নিয়ে মুর্শিদাবাদের সমশেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ানের মতো এলাকায় সদ্য ঘটে যাওয়া হিংসা সেই মেরুকরণকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল। পহেলগাঁওয়ের ঘটনা কি তা আরও তীব্র করল? শাসক তৃণমূল এবং প্রধান বিরোধীদলের নেতারা আনুষ্ঠানিক ভাবে মানতে চাইছেন না। কিন্তু দু’পক্ষের অনেকে আবার একান্ত আলোচনায় বলছেন, বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে পহেলগাঁও মেরুকরণের পারদ কয়েক গুণ চড়িয়ে দিয়েছে। যার অন্যতম সূচক হয়ে উঠেছে পহেলগাঁওয়ে নিহত রাজ্যের বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা। যা শুরু হল কলকাতা বিমানবন্দর থেকে।

Advertisement

বাইরের রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রাজ্যের কারও মৃত্যু হওয়ার পর তাঁদের দেহ বিমানবন্দরে পৌঁছলে এত দিন দেখা যেত শুধু মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিম, সুজিত বসুদের। কিন্তু বুধবার সদলবদলে বিমানবন্দরে চলে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর সঙ্গে যেমন বিজেপি বিধায়কদের একাংশ ছিলেন, তেমনই ছিলেন লোকসভার সাংসদ তথা প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যেরাও।

পহেলগাঁওয়ে নিহত বিতান অধিকারী এবং সমীর গুহর কফিনবন্দি দেহ এসে পৌঁছোনোর পরে নিয়ম অনুযায়ী কলকাতা বিমানবন্দরের ‘কার্গো গেট’ দিয়ে সেগুলি বাইরে নিয়ে আসা হয়। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ চার নম্বর কার্গো গেট দিয়ে কফিনগুলি বাইরে নিয়ে আসা হয়। দ্রুত ময়দানে অবতীর্ণ হন শুভেন্দু। দু’টি কফিনের একটির সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে হাতজোড় করে প্রণাম করেন। তার পরে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘‘এঁরা হিন্দু শহিদ! আমি এঁদের প্রণাম করি।’’ তার পরে কফিনের এক পাশে গিয়ে খালিপায়ে হাঁটু মুড়ে কফিনে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। অতঃপর চলে যান অন্য কফিনটির সামনে। আবার বলতে থাকেন, ‘‘হিন্দু বলে মেরেছে!’’ শুভেন্দুর ঠিক পিছনে তখন দাঁড়িয়ে মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ।

বৈষ্ণবঘাটার বাসিন্দা বিতানের দেহ যখন বার করা হচ্ছিল, তখন কফিনের পাশে ছিলেন বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। পাশে বিতানের স্ত্রী সোহিনী। অগ্নিমিত্রার কোলে বিতান-সোহিনীর শিশুপুত্র হৃদান। কার্গো গেটের বাইরে অগ্নিমিত্রার কোল থেকে হৃদানকে কোলে নিয়ে নেন শুভেন্দু। তার পর সদ্যবিধবা সোহিনীকে বলেন, ‘‘বলুন আপনি, হিন্দু বলে মেরেছে! কাল রাতে আমায় বলেছেন। হিন্দু বলে মেরেছে।’’ বলেই হৃদানের গালে চুম্বন করেন বিরোধী দলনেতা। সোহিনী কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, ‘‘ওরা জিজ্ঞেস করল, আপনি কি মুসলিম? কলমা পড়তে পারেন? ‘না’ বলতেই মেরে দিল!’’ শুভেন্দু আবার বলেন, ‘‘বলুন ওই সেকুলারদের! বলুন, হিন্দু বলে মেরেছে!’’ হৃদানকে আবার চুম্বন করে শুভেন্দু বলেন, ‘‘ওর সব দায়িত্ব আমার। ওর সব দায়িত্ব আমার।’’

যে নাটকীয়তার সঙ্গে শুভেন্দু গোটা বিষয়টি ঘটিয়ে ফেলেন, তাতে সম্ভবত খানিকটা হকচকিয়েই গিয়েছিলেন ফিরহাদেরা। তবে শাসক শিবির একেবারে পিছিয়েও থাকেনি। রাত ৯টা নাগাদ বিতানের কফিনবন্দি দেহ যখন তাঁর বৈষ্ণবঘাটার বাড়িতে পৌঁছোয়, তখন দেখা যায় হৃদান মন্ত্রী অরূপের কোলে! পাশে সোহিনী। আর ফিরহাদ তখন পৌঁছেছেন বেহালায় সমীরের বাড়িতে। তাঁর পরিজনদের পাশে।

যে ঘটনাপ্রবাহ বুধবার বিমানবন্দর থেকে বৈষ্ণবঘাটা বা বেহালায় দেখা গিয়েছে, সাম্প্রতিককালে তার নজির আছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘‘বাংলার যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের দেহ ফেরানোর সব ব্যবস্থা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি নাটক করতে বিমানবন্দরে গিয়ে ওই সব করেছে।’’ পাল্টা বিজেপির অগ্নিমিত্রা বলেছেন, ‘‘দেহ ঘিরে রাজনীতি করা তৃণমূলের বহু দিনের সংস্কৃতি। আমাদের মজ্জায় ও সব নেই। আমরা ওঁদের পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিলাম।’’

প্রসঙ্গত, পহেলগাঁওয়ে নিহত মণীশরঞ্জন মিশ্রের দেহ বৃহস্পতিবার রাঁচি হয়ে পুরুলিয়ার ঝালদায় তাঁর বাড়িতে পৌঁছেছে। সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। তারই পাশাপাশি তৃণমূল, বাম এবং কংগ্রেসের মতো বিজেপির বিরোধী বিভিন্ন দলের নেতারা বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে মাঠে নেমেছেন জম্মুর উধমপুরে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত সেনা জওয়ান, নদিয়ার তেহট্টের বাসিন্দা ঝন্টু আলি শেখের ছবি নিয়ে। ধর্মে মুসলিম ঝন্টুর ছবি পোস্ট করে তৃণমূলের কুণাল লিখেছেন, ‘‘ধর্ম খুঁজছেন? দেখুন। জম্মু ও কাশ্মীরের উধমপুরে সেনা-জঙ্গির গুলির লড়াইয়ে শহিদ ঝন্টু আলি শেখ।’’ ঝন্টুর বাড়িতে পৌঁছেছেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক তাপস সাহা। শুক্রবার যাচ্ছেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের দু’মাস আগে পুলওয়ামায় সেনাবাহিনীর কনভয়ে জঙ্গি হামলা হয়েছিল। সেই ঘটনার পরে সারা দেশে ‘জাতীয়তাবাদী আবেগ’ কাজ করেছিল। ভোটে যার ‘সুফল’ পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি ধর্ম যাচাই করে খুন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিহতদের আত্মীয়রা। যা অতীতের অন্য জঙ্গি হামলার সঙ্গে এই ঘটনার মৌলিক পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে।

কী ভাবে সেনাবাহিনীর নজর এড়িয়ে জঙ্গিরা ঢুকে ওই হত্যালীলা চালাল, সে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষত, যখন সপ্তাহ দুয়েক আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্বয়ং বলেছিলেন, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে! প্রশ্ন রয়েছে যে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে কি কোনও খবর ছিল না? কিন্তু এ সব প্রশ্ন ধর্মীয় মেরুকরণের সামনে ধোপে টিকতে পারছে না। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার যেমন প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘যখনই ভারতের উপর আক্রমণ হয়, আমরা ন্যায়বিচার এবং পাল্টা আক্রমণের কথা বলি। কিন্তু নিজেদের জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন যে, এই ধরনের আক্রমণ কেন ঘটতে দেওয়া হল?’’ শুভঙ্কর প্রশ্ন তুলছেন বটে। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতারাও মানছেন, পরিস্থিতি যে জায়গায় যাচ্ছে, তাতে এ সব কথাকে জনতার একটা অংশ ‘স্বাভাবিক’ ভাবে নিচ্ছে না। সম্ভবত সেই কারণেই সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘মৌলবাদ সব সময়েই বিপজ্জনক। এ-ও বাস্তব যে, একটা মৌলবাদ বিপরীত মৌলবাদকে পুষ্ট করে। আর কিছু রাজনৈতিক দল তা ব্যবহার করে ধর্মের জিগির তুলতে চায়।’’

Advertisement
আরও পড়ুন