west bengal by-election

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তিনটি উপনির্বাচনে হেরে গিয়েছিল বামেরা, এই ‘দ্রোহকালে’ সেই পরীক্ষা তৃণমূলেরও

উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এবং পশ্চিমাঞ্চলের দু’টি করে আসনে উপনির্বাচন হবে। তৃণমূল মনে করছে, উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ, কলকাতা লাগোয়া এলাকা থেকে জঙ্গলমহল— সব ধরনের এলাকার জনমত উঠে আসবে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:৫৫
West Bengal By Election 2024: TMC starts their Preparation

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।

আরজি কর-আন্দোলনের জেরে সরকার তথা শাসকদল তৃণমূল কি ‘চাপে’? চার মাস আগে লোকসভা ভোটে বিপুল জয় পাওয়া তৃণমূলের কি জনসমর্থন আলগা হয়েছে? চলমান নাগরিক আন্দোলনের এই পর্বকে অনেকেই ‘দ্রোহকাল’ বলে অভিহিত করছেন। ঠিক সেই পর্বেই রাজ্যের ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। তৃণমূল শিবিরের অন্দরের দাবি, তারাও এই ‘কঠিন’ সময়ে পরীক্ষায় বসতে চাইছিল। ভোট ঘোষণা হতেই প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন শাসকদলের নেতৃত্ব। একান্ত আলোচনায় তৃণমূলের নেতারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলছেন, আরজি কর আন্দোলনের কোনও প্রভাব ভোটের বাক্সে পড়বে না। হাসতে হাসতেই জিতবেন তাঁরা। অন্য দিকে বাম-কংগ্রেসের মতো বিরোধীরাও হলফ করে বলতে পারছে না, উপনির্বাচনে আরজি কর আন্দোলনের ‘ছাপ’ পড়বে। তবে বিজেপি আশাবাদী, ছ’টির মধ্যে অন্তত পাঁচটি আসনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।

Advertisement

উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এবং পশ্চিমাঞ্চলের দু’টি করে আসনে বিধানসভার উপনির্বাচন হবে। তালিকায় রয়েছে কোচবিহারের সিতাই, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া এবং নৈহাটি, বাঁকুড়ার তালড্যাংরা ও পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর বিধানসভা। ২০২১ সালে এই ছ’টির মধ্যে শুধু মাদারিহাট জিতেছিল বিজেপি। বাকি পাঁচটিতেই জিতেছিল তৃণমূল। ঘটনাচক্রে, এই ছয় বিধায়কই গত লোকসভায় জিতে সাংসদ হয়েছেন। ফলে তাঁদের আসনগুলিতে উপনির্বাচন হচ্ছে। তৃণমূল মনে করছে, উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ, কলকাতা লাগোয়া এলাকা থেকে গ্রামাঞ্চল, জঙ্গলমহল— এই ভোটে সার্বিক ভাবে সব ধরনের এলাকার জনমত উঠে আসবে। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘আমরা তো চাই পরীক্ষা হোক। এই যে মানুষের ক্ষোভের কথা বলা হচ্ছে বা দেখানো হচ্ছে, ভোটে স্পষ্ট হয়ে যাক, তার কতটা স্বতঃস্ফূর্ত আর কতটা সাজানো। অনেক কুৎসা হয়েছে। আমরা আরজি করের ঘটনার নিন্দা করে সত্যটা বলে গিয়েছি। পুজোর কার্নিভাল হয়েছে, দ্রোহের কার্নিভালও হয়েছে। এ বার আসুন ভোটের কার্নিভালে।’’

সাধারণত উপনির্বাচনে শাসকদলই জেতে। কারণ, এই ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার বদলের সুযোগ থাকে না। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পরে রাজ্যে তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে সিপিএম তথা বামেদের পরাস্ত করে জিতেছিল তৃণমূল। ২০০৯ সালে জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জে জিতেছিলেন খগেশ্বর রায়। খগেশ্বরই উত্তরবঙ্গের প্রথম তৃণমূল বিধায়ক। ওই বছরই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর পশ্চিম (আসন পুনর্বিন্যাসের পরে ওই কেন্দ্র এখন আর নেই) আসন থেকে জিতেছিলেন মদন মিত্র। সিপিএম নেতা তথা তৎকালীন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী প্রয়াত হন ২০০৯ সালের ৩ অগস্ট। তাঁর কেন্দ্র পূর্ব বেলগাছিয়া (আসন পুনর্বিন্যাসের পরে এই কেন্দ্রটিও এখন আর নেই) আসনে সিপিএম প্রার্থী করেছিল সুভাষ-জায়া রমলা চক্রবর্তীকে। তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে রমলাকে পরাস্ত করেছিলেন সুজিত বসু। যিনি এক সময়ে সুভাষেরই ‘স্নেহধন্য’ ছিলেন।

তবে তৃণমূল জমানাতেও উপনির্বাচনে তৃণমূলের হারের নজির রয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সঙ্গেই কয়েকটি বিধানসভার উপনির্বাচন হয়েছিল। সেই সময়ে অর্জুন সিংহের ছেড়ে আসা ভাটপাড়া আসনে বিজেপির প্রার্থী হয়ে লড়েছিলেন তাঁর পুত্র পবন সিংহ। তৃণমূলের মদনকে হারিয়ে দিয়েছিলেন বিজেপির পবন। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীকে পরাস্ত করেছিলেন সিপিএম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। যে ফলাফল রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। যদিও বাইরন জয়ের তিন মাসের মধ্যেই কংগ্রেস ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উন্নয়নে’ শামিল হতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। তার পর থেকে তৃণমূল সব ভোটেই জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছে।

কিন্তু এই ছ’টি উপনির্বাচন ‘আলাদা’। কারণ, আরজি কর আন্দোলনের প্রভাব এই ভোটে পড়বে কি না, রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক, সব মহলই তা নিয়ে কৌতূহলী। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে গত অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে তুমুল নাগরিক আন্দোলন দেখেছে বাংলা। জেলায় জেলায় ছোট শহর, মফস্সলও আন্দোলনে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে তা ক্রমশ ‘কলকাতাকেন্দ্রিক’ হয়ে পড়েছে। এখন যা মধ্য কলকাতায় জুনিয়র ডাক্তারদের ‘আমরণ অনশন’ করার মঞ্চ ঘিরে কেন্দ্রীভূত।

আরজি কর নিয়ে নাগরিক আন্দোলনে সিপিএম ধারাবাহিক ভাবে মিশে থেকেছে। সাংগঠনিক ভাবে সিপিএম এবং তাদের গণসংগঠনগুলিও পৃথক ভাবে রাস্তায় থেকে আন্দোলন করেছে। কুণাল সিপিএমের উদ্দেশেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘ওদের যে ডাক্তারবাবুরা বাজার গরম করলেন, হিম্মত থাকলে তাঁদের ভোটে প্রার্থী করুক। সাদা-কালোয় সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।’’ সিপিএম নেতা শমীক লাহিড়ী অবশ্য হলফ করে বলতে পারেননি উপনির্বাচনে আরজি কর-আন্দোলনের প্রভাব পড়বেই। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্নীতি এবং দুষ্কৃতীরাজের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। তাই মানুষ আন্দোলনে নামছেন।’’ কিন্তু বাম আমলের শেষ পর্বে আন্দোলনের অভিঘাত তো প্রতিফলিত হয়েছিল ভোটবাক্সে? শমীকের জবাব, ‘‘সব প্রতিফলন তো ভোটে সব সময় হয় না। এ ক্ষেত্রে হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারও বলেছেন, ‘‘মানুষ কী করবেন সেটা মানুষই ঠিক করবেন।’’ যদিও প্রদেশ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বলছেন, গ্রামাঞ্চলে আরজি কর আন্দোলনের কোনও প্রভাব নেই। কলকাতা লাগোয়া জেলাগুলিতে যে তরঙ্গ উঠেছিল, তা-ও খানিকটা স্তিমিত।

রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ীর অবশ্য দাবি, হাড়োয়া বাদ দিয়ে বাকি পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনেই আরজি কর আন্দোলনের প্রভাব পড়বে। তাঁর যুক্তি, যে হেতু হাড়োয়ায় মুসলিম ভোটই ‘নির্ণায়ক শক্তি’, সেখানে তৃণমূল ‘মেরুকরণের রাজনীতি’ করবে। বাকি পাঁচটি ক্ষেত্রে তৃণমূলের সেই সুযোগ নেই। রাজর্ষির কথায়, ‘‘আরজি করের ঘটনা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। তৃণমূলের যে গরিব কর্মী বা সমর্থক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান, তিনিও বিপন্ন বোধ করছেন। তিনিও ভাবছেন, তাঁর শরীরে ব্যবহার করা পুরনো সিরিঞ্জের সুচ ঢুকছে না তো? এর প্রভাব ভোটে পড়বেই।’’

তবে অনেকের মতে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির ‘মৌলিক পার্থক্য’ রয়েছে। তখন নাগরিক আন্দোলন ছিল কয়েকটি ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক মুখ হয়ে উঠেছিলেন মমতাই। তিনি পাশে পেয়েছিলেন কংগ্রেস, এসইউসি, পিডিএসের মতো দলকেও। সেই সময়ে বিজেপির এই শক্তি ছিল না। ফলে বামেদের বিরুদ্ধে সব ভোট একত্র হয়েছিল। ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াইয়ের ফসল ঘরে তুলেছিল তৃণমূল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি তেমন নয়। বামেরা এখন ‘প্রান্তিক’ শক্তিতে পরিণত। উপরন্তু যে নাগরিক আন্দোলনে শাসকদল বা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে, সেখানে কিন্তু বিজেপির প্রতি সমর্থন সে ভাবে নেই। বরং তাদের বড় অংশ বিজেপিকে ‘বড় শত্রু’ হিসাবে দেখতে এবং দেখাতে চায়। যা তৃণমূলের জন্য ‘সুবিধাজনক’। তৃণমূলও মনে করছে, ছ’টি আসনেই তাদের মূল লড়াই বিজেপির সঙ্গে। উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলে বামেদের কোনও শক্তি নেই বললেই চলে। শাসকদলের অনেকের বক্তব্য, নৈহাটির মতো কলকাতার কাছাকাছি আসনে বামেদের অল্পবিস্তর ভোট বাড়লেও বাড়তে পারে। কিন্তু তা রাজনৈতিক ভারসাম্যে কোনও বদল আনবে না।

আগামী ১৩ নভেম্বর ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন ছ’টি বিধানসভা এলাকার মানুষ। আরজি কর আন্দোলনে তাঁরা প্রভাবিত কি না, তা স্পষ্ট হবে ২৩ নভেম্বর দুপুরের মধ্যে।

আরও পড়ুন
Advertisement