West Bengal BJP & Ram Navami

বিজেপির ‘পাখির চোখ’ এখন রামনবমী! ঘোষণা করে দিয়েও ৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতুবি রাখা হচ্ছে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি

রামনবমী উদ্‌যাপন ঘিরে রাজ্য জুড়ে বেনজির শক্তিপ্রদর্শনের পরিকল্পনা করেছে বিজেপি। রাজ্য নেতৃত্ব অবশ্য প্রকাশ্যে সে কথা মানছেন না। রামনবমী আয়োজনে বিজেপির ‘প্রত্যক্ষ’ ভূমিকা নেই বলেই বরং দাবি করা হচ্ছে।

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫ ১০:০২
West Bengal BJP paused all major political movements till Ram Navami

(বাঁ দিক থেকে) সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

রাম-রাজনীতির হাত ধরেই হোক, বা না-ধরেই হোক, বাংলাতেও এখন রামনবমীর রমরমা বেড়েছে। বিজেপি এখানে সরাসরি রামনবমীর কোনও কর্মসূচি নেয়নি ঠিকই, কিন্তু আসন্ন সব দলীয় কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রেই মাথায় রেখে চলছে ৬ এপ্রিল দিনটিকে।

Advertisement

২০২৬ সালের ভোটের দিকে নজর রেখে একগুচ্ছ রাজনৈতিক হাতিয়ারে শান দেওয়ার চেষ্টা করছে বঙ্গ বিজেপি। সে হাতিয়ার নিয়ে ময়দানে নামা হবে বলে ‘হুঙ্কার’ও শোনানো হচ্ছে। কিন্তু কবে ময়দানে নামা হবে, তার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা নেই। কারণ রামনবমীই। এ বারের রামনবমী উদ্‌যাপন ঘিরে রাজ্য জুড়ে বেনজির শক্তিপ্রদর্শনের পরিকল্পনা করেছে বিজেপি। যদিও প্রকাশ্যে বিজেপি নেতৃত্ব সে কথা মানছেন না। রামনবমী আয়োজনে বিজেপির ‘প্রত্যক্ষ’ ভূমিকা নেই বলেই বরং দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হল, অন্তত তিনটি বিষয় নিয়ে পথে নামার কথা ঘোষণা করেও সেগুলি রামনবমী না-মেটা পর্যন্ত বিজেপি মুলতুবি রেখে দিয়েছে।

গত রবিবার সল্টলেকে বিজেপির রাজ্য দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। নদিয়ার কৃষ্ণনগরে এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বাগদায় বেছে বেছে ভোটার তালিকা থেকে হিন্দু নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। এই বিষয়ে বিজেপি পথে নামবে বলে সে দিনের সাংবাদিক বৈঠকে শুভেন্দু ঘোষণা করেন। কিন্তু পথে কবে নামা হবে? শুভেন্দু জানান, রামনবমীর পরে। কৃষ্ণনগর-২ এবং বাগদার বিডিও অফিসে ধর্না হবে, প্রয়োজনে তিনি নিজে সেখানে যাবেন। তিনি আরও জানান, বিডিও অফিসে ধর্নায় কাজ না-হলে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতরে গিয়ে ধর্নায় বসবেন। কিন্তু সবই হবে রামনবমীর পরে।

রবিবারের সেই সাংবাদিক বৈঠকে শুভেন্দুরা আরও এক ‘গুরুতর’ অভিযোগ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তুলেছেন। একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আসা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার তা আটকে রেখেছে, উপভোক্তা বা প্রাপকদের দিচ্ছে না বলে শুভেন্দু দাবি করেন। সেগুলির মধ্যে ‘জাতীয় গ্রামীণ আজীবিকা মিশনে’ (এনআরএলএম) কেন্দ্রীয় সরকার যে টাকা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য পাঠিয়েছে, তা ৩১ মার্চের মধ্যে গোষ্ঠীগুলিকে দিয়ে দেওয়ার দাবি তুলে শুভেন্দু সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিলেন। না হলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দরবার করে ওই টাকা সরাসরি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যাদের ব্যাঙ্ক খাতায় জমা করার দাবি বিজেপি তুলবে বলে শুভেন্দু জানান। বিজেপি সূত্রের খবর, কেন্দ্র টাকা পাঠালেও রাজ্য যে আটকে রেখেছে, সে বিষয়ে রাজ্যবাসীকে সচেতন করতে দল রাস্তায় নামার কথা ভাবছে। কিন্তু কবে? বিজেপি সূত্রের খবর, রামনবমীর আগে নয়।

বুধবার মুরলীধর সেন লেনে বিজেপির পুরনো রাজ্য দফতরে শুভেন্দু আরও একটি সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’র (ওবিসি) তালিকা আবার যাচাই করার জন্য রাজ্য সরকার যে সমীক্ষা শুরু করেছে, সেই সমীক্ষার বৈধতা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন তোলা হয়। সমীক্ষাটির বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে ইতিমধ্যেই একটি মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলায় যুক্ত হওয়ার জন্য রাজ্য বিজেপির ওবিসি মোর্চা হাই কোর্টে আবেদন জানাতে চলেছে বলে শুভেন্দু ঘোষণা করেন। পাশাপাশি তিনি ইঙ্গিত দেন যে, রাজনীতির ময়দানেও এই বিষয়কে ‘হাতিয়ার’ করে তোলার পরিকল্পনা বিজেপি নিচ্ছে। কিন্তু সে বিষয়েও রামনবমীর পরেই ময়দানে নামা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

এত রকম রাজনৈতিক ‘হাতিয়ার’ বিজেপির হাতে। কিন্তু সে সবের প্রয়োগ মুলতুবি কেন রাখা হচ্ছে? এ বছরের রামনবমী ঘিরে কী এমন পরিকল্পনা বিজেপির যে, অন্য সব কর্মসূচিকে রামনবমী মেটার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে? বিজেপি নেতৃত্ব এই প্রশ্নের সরাসরি বা স্পষ্ট জবাব দিচ্ছেন না। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘রামনবমী নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা আবেগ, উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই সেটা দেখা যাচ্ছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রামনবমীর মিছিলে শামিল হচ্ছেন। এ বারও শামিল হবেন। মানুষের সেই আবেগের কথা তো বিজেপিকে খেয়াল রাখতে হবে।’’ তবে বিজেপি নিজে রামনবমীকে শক্তিপ্রদর্শনের অবকাশ হিসেবে দেখছে বলে শমীক মানছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘এটা বিজেপির কোনও অনুষ্ঠান নয়। সব হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে রামনবমী পবিত্র দিন। বহু বিজেপি কর্মীও রামনবমীর শোভাযাত্রার আয়োজনে যুক্ত থাকবেন। কিন্তু বিজেপি দলগত ভাবে কোনও শোভাযাত্রার আয়োজন করছে না। বিজেপির কোনও শক্তিপ্রদর্শনের পরিকল্পনাও নেই।’’

শুভেন্দুর মন্তব্যে কিন্তু একাধিক বার শক্তিপ্রদর্শনের পরিকল্পনা সংক্রান্ত আভাস মিলেছে। সরাসরি তিনিও রামনবমীকে বিজেপির কর্মসূচি বলেননি। কিন্তু গত কয়েক দিনে একাধিক বার শুভেন্দু বলেছেন, ‘‘এ বার রামনবমীর উদ্‌যাপন দেখে নেবেন। সরস্বতীপুজোতেও আপনারা দেখেছেন, বাধা দিলে কী হয়। রামনবমীতেও দেখবেন। আর রামনবমীর পরে হনুমান জয়ন্তীতেও দেখবেন কত মিছিল হয়।’’

বিধানসভায় শুভেন্দুর সহকর্মী তথা বিরোধীদলের মুখ্য সচেতক শঙ্কর ঘোষ অবশ্য শমীকের মতোই সাবধানি। শঙ্করের নিজের শহর শিলিগুড়িতে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বড় রামনবমী শোভাযাত্রাগুলির একটি হয়। তবু শঙ্কর সতর্ক মন্তব্য করছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দলগত ভাবে বিজেপি কোথাও রামনবমীর অনুষ্ঠান আয়োজন করছে না। সব জায়গাতেই রামনবমী উদ্‌যাপন সমিতি রয়েছে। তারাই আয়োজন করছে। স্বাভাবিক কারণেই অনেক বিজেপি কর্মী নিজের নিজের এলাকায় সে আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাঁদের নিয়ে এই মুহূর্তে অন্য কোনও কর্মসূচিতে নামা কঠিন।’’

নেতারা যা-ই বলুন, বিজেপি যে রামনবমী উদ্‌যাপনে এ বার সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে চলেছে, সে খবর দলীয় সূত্রেই পাওয়া যাচ্ছে। আয়োজক হিসেবে বিজেপি কোথাও নেই, সে কথা ঠিক। কিন্তু রামনবমী উদ্‌যাপনে তৈরি হওয়া কমিটিগুলির মধ্যে সঙ্ঘ পরিবারের অন্য সংগঠনগুলির মতো বিজেপি কর্মীরাও রয়েছেন। এবং নেতৃত্বের নির্দেশেই তাঁরা রামনবমীর শোভাযাত্রাকে বহরে বাড়ানোর চেষ্টায় রত বলেও জানা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে অন্য কোনও কর্মসূচিতে কর্মীদের টানার চেষ্টা করলে রামনবমীর আয়োজনে ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা। ৬ এপ্রিল রামনবমী না-কাটিয়ে তাই অন্য কোনও দিকে নজর দিতে বিজেপি নারাজ। এ বারের রামনবমীর জমায়েত যদি অন্য সব বছরকে ছাপিয়ে যেতে পারে, তা হলে পরের কর্মসূচিগুলিতে কর্মীরা আরও বেশি উদ্যমে মাঠে নামবেন বলে বিজেপি নেতৃত্বের ধারণা।

Advertisement
আরও পড়ুন