West Bengal Panchayat Election 2023

দেওয়াল লেখাবেন গো, দেওয়াল... এমন হাঁক দেওয়া লোকেরা ভোটের বাজারে মোটা দর হাঁকছেন

পেশাদার শিল্পীরা সাধারণত বর্গফুট হিসাবেই মজুরি নিয়ে থাকেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে বর্গফুট প্রতি খরচ ২-৩ টাকা ছিল, এ বার বাড়তি চাহিদা বুঝে ৪-৫ টাকা চাইছেন শিল্পীরা।

Advertisement
প্রণয় ঘোষ
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৩ ১৯:৫০
panchayat Election 2023

গত কয়েক বছরে দেওয়াল লিখনে পেশাদারিত্বের ছোঁয়াও লেগেছে। শিল্পীদের ডেকে তাঁদের হাতের নিখুঁত বাহারি লেখায় নজর কাড়তে চান প্রার্থীরা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সকাল থেকে আসছি, আসব করেও রাত পর্যন্ত দেখা পাওয়া যায়নি। দু’দিন পরে দেখা মিললেও মাত্র চারটি দেওয়াল লিখতে যা দর হেঁকেছেন শিল্পী, তা শুনে কার্যত ভিরমি খাওয়ার জোগাড় পঞ্চায়েত ভোটের প্রার্থীর। কারণ, আরও শ’খানেক দেওয়াল লেখার বরাত দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর! পঞ্চায়েতের মতো একেবারে নিচুতলার ভোটে প্রার্থীদের প্রচারের অন্যতম অস্ত্র সেই দেওয়াল লিখন নিয়ে এখন কার্যত মাথায় হাত রাজনৈতিক দলগুলির। কিছু জায়গায় দলের তরুণ কর্মীরা ‘মুশকিল আসান’ হয়ে উঠলেও সকলের কী আর শিল্পীদের মতো হাতের টান থাকে! এই পরিস্থিতিতে পাড়ার পাঁচিল বা বাড়ির দেওয়াল ছেড়ে এখন ফেসবুকের দেওয়ালে প্রচারে জোর দিচ্ছেন প্রার্থীরা।

রাজনৈতিক প্রচারের গতিপ্রকৃতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে গত এক দশকে। লোকসভা বা বিধানসভার মতো বড় নির্বাচনগুলিতে সমাজমাধ্যমকে হাতিয়ার করাই এখন দস্তুর হয়ে উঠেছে। কিন্তু একেবারে স্থানীয় স্তরের ভোটে পোস্টার, ব্যানার, বিশেষত দেওয়াল লিখনে বেশি কাজ হয় বলে আজও মনে করে রাজনৈতিক দলগুলি। এতে খরচও কম। গত কয়েক বছরে দেওয়াল লিখনে পেশাদারিত্বের ছোঁয়াও লেগেছে। শিল্পীদের ডেকে তাঁদের হাতের নিখুঁত বাহারি লেখায় নজর কাড়তে চান প্রার্থীরা। কিন্তু এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে শিল্পীদের জোগানেই ঘাটতি! কোথাও আবার দু-এক জন মিললেও তাঁরা বিপুল দর হেঁকে বসছেন। তৃণমূলের এক জেলার নেতার কথায়, ‘‘এখন তো পাওয়াই যাচ্ছে না এঁদের (শিল্পীদের)! গত পঞ্চায়েত ভোটেও এই সমস্যাটা হয়নি। কিন্তু এ বার হচ্ছে। কেউ কেউ এত টাকা চেয়ে বসছেন যে, কাজ করানোই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য খরচও তো রয়েছে।’’

Advertisement

পেশাদার শিল্পীরা সাধারণত বর্গফুট হিসাবেই মজুরি নিয়ে থাকেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে বর্গফুট প্রতি খরচ ২-৩ টাকা ছিল, এ বার বাড়তি চাহিদা বুঝে ৪-৫ টাকা চাইছেন শিল্পীরা। ফলে রং এবং অন্যান্য সামগ্রী সমেত ১০০ বর্গফুটের একটি দেওয়াল লিখতে খরচ পড়ে যাচ্ছে ৭০০-৮০০ টাকা। নদিয়ায় জেলা পরিষদের এক প্রার্থী বলছেন, ‘‘আমার এলাকায় ১০০টা দেওয়াল বেছে রেখেছিলাম লেখাব বলে। কিন্তু এত টাকা কোথা থেকে দেব! সম্ভবই না।’’

শিল্পীদের অবশ্য বক্তব্য, বাজারে জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে বাড়ছে, তাতে মজুরি না বাড়ালে পেট চালানো সম্ভব নয় তাঁদের পক্ষে। দীর্ঘ দিন ধরে ভোটের মরসুমে দেওয়াল লেখেন করিমপুরের বাসিন্দা লতিফ মণ্ডল। তিনি বলছেন, ‘‘এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার খরচ এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। তুলি আরও অন্যান্য সরঞ্জামের খরচও প্রচুর এখন। তা ছাড়া, বাজারে জিনিসপত্রের দামও দেখুন! সেই তুলনায় আমাদের মজুরি আর কতই বা বাড়ল?’’ রানাঘাটের প্রদীপ হাওলাদারও রঙের কাজ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘সারা বছর তো ওদের (রাজনৈতিক দলগুলির) পায়ে পড়ে থাকতে হবে। এই ক’টা দিন আমরাও একটু খেলিয়ে নিতে চাই। আমরা গরিব মানুষ। আমাদেরও খেয়েপরে বাঁচতে হবে। মজুরি কমাতে বললে দেওয়ালে লিখে দিয়ে চলে আসব। শ্রমিকদের নিয়ে তো সব বড় বড় ভাষণ দেয়। আমাদের সঙ্গে এত দরদাম করার কী আছে?’’

এই অবস্থায় সমাজমাধ্যমে প্রচারের দিকেই ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রামের নেতারা। ভাষণের ছোট ছোট ভিডিয়ো তৈরি করে তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এই ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই বিভিন্ন পেশাদার সংস্থাকে নিয়োগ করা হচ্ছে। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগেই কৃষ্ণনগরে এ রকম একটি ‘হাইটেক’ প্রচারের সংস্থা তৈরি হয়েছে। তার কর্ণধার রূপেশ কর্মকার বলেন, ‘‘কয়েক মিনিটে কয়েক লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হাতছাড়া করতে চাইছেন না কোনও প্রার্থী। আমরা পেশাদার হিসাবে সেই কাজ করে চলেছি। পঞ্চায়েত ভোটের মুখে আমাদের ক্লায়েন্ট সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০০ ছুঁয়ে গিয়েছে।’’

বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলের তরুণ কর্মীরাই এই ধরনের হাইটেক প্রচারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলির বক্তব্য, এতে খরচও যেমন কমেছে, তেমনই নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। শুধু নতুন প্রজন্মই নয়, মধ্যবয়সি ভোটারদের মধ্যেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলেই দাবি অনেক নেতার।

কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা বিজেপির সভাপতি অর্জুন বিশ্বাস বলেন, ‘‘এক-একটা দেওয়াল লিখতে ৫০০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। আর্থিক চাপ কমাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের আইটি সেলের কর্মীরা হাইটেক প্রচারের দিকে জোর দিচ্ছে।’’ নদীয়া জেলা পরিষদের প্রার্থী টিনা ভৌমিক সাহার কথায়, ‘‘বলে বলে লোক পাওয়া যাচ্ছে না! তাই দেওয়াল লিখনে খুব বেশি জোর না দিয়ে এখন সমাজমাধ্যমে প্রচারেই বেশি জোর দিচ্ছি।’’

গ্রামবাংলায় অবশ্য এই কৌশল কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে আবার অনেক নেতাই সন্দিহান। জেলা তৃণমূলের সভাপতি বর্ষীয়ান নেতা কল্লোল খাঁ যেমন বলছেন, ‘‘দেওয়ালে প্রচারের একটা অন্য মাহাত্ম্য আছে। সব ধরনের মানুষ দেখতে পান। সকলের কাছে তো মোবাইল থাকে না। আর তা ছাড়া, এটা তো নিচুতলার ভোট। ছোট এলাকা। সেখানে সমাজমাধ্যমে প্রচার কতটা কাজে আসবে, আমার সন্দেহ আছে। বড় এলাকার ভোট হলে সমাজমাধ্যম খুব ঠিকঠাক। কিন্তু ছোট এলাকায় এই কৌশল কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। দেখা যাক।’’

আরও পড়ুন
Advertisement