খুন, জালিয়াতি, রাহাজানি এবং বোমাবাজির ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নরেন্দ্রপুরের বাসিন্দাদের একাংশ। নিজস্ব ছবি।
এক মাসের মধ্যে দু-দু’টি বোমাবাজির ঘটনায় আবারও জল্পনা এবং আলোচনায় ‘নরেন্দ্রপুর’!
একদা ‘নরেন্দ্রপুর’ নামটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের নাম। আলোচনা হত নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মানুষ গড়ার সাফল্যের দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মিশনের পড়ুয়াদের কৃতিত্বের কাহিনি নিয়ে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধাতালিকার উপরের দিকে থাকতেন নরেন্দ্রপুরের ছাত্রেরা। চর্চা হত প্রতিষ্ঠানের ‘লৌহকঠিন’ শৃঙ্খলারও।
সেই আলোচনা বা চর্চা এখনও একেবারে হয় না, তা নয়। তবে সম্প্রতি নরেন্দ্রপুর একেবারে কিছু ভিন্ন কারণে আলোচনায় আসতে শুরু করেছে। অনেকের আশঙ্কা, এই ধারা বজায় থাকলে নষ্ট হবে নরেন্দ্রপুর নামটির ‘মাহাত্ম্য’। খুন, জালিয়াতি, রাহাজানি এবং বোমাবাজির ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। তবে এর জন্য নরেন্দ্রপুরের হঠাৎ-নগরায়ণ এবং সামগ্রিক ভাবে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতিকেই দুষছেন সমাজকর্মীরা।
প্রত্যাশিত ভাবেই সে অভিযোগ মানতে চাইছে না পুলিশ প্রশাসন। বারুইপুর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার (সদর) মাকসুদ হাসান বলেন, ‘‘মানুষ এখানে অনেক নিরাপদেই চলাফেরা করেন। অপরাধ হচ্ছে বলেই জায়গায় জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। তার মানে এই নয় যে, নরেন্দ্রপুরে অপরাধের সংখ্যা বেড়়ে গিয়েছে।’’
ঘটনাচক্রে, গত সোমবারই গভীর রাতে বোমাবাজির ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে নরেন্দ্রপুর থানা এলাকায় গড়িয়া স্টেশনের কাছে নবপল্লি এলাকায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা তিন-তিনটি বোমাও উদ্ধার করেছে। গত মাসেও নরেন্দ্রপুরের দাসপাড়া এলাকায় দুপুরে মাঠে খেলতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমায় গুরুতর আহত হয়েছিল পাঁচ নাবালক। সমাজকর্মীদের বক্তব্য, বীরভূমে বগটুই-কাণ্ডের পরেই রাজ্যে বেআইনি ভাবে মজুত বোমা-অস্ত্র দ্রুত উদ্ধারের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্তত নরেন্দ্রপুরে সেই উদ্যোগ যে নেওয়া হচ্ছে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তার প্রমাণ মেলেনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, বর্তমানে অপরাধীদের ডেরায় পরিণত হয়েছে নরেন্দ্রপুর। কলকাতা এবং লাগোয়া এলাকায় নানা অপরাধমূলক কাজকর্ম করে ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের জন্য এই জায়গাটিকেই বেছে নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। অক্টোবরে বোমাবাজির ঘটনার পুলিশি তদন্তেও এই তত্ত্ব উঠে এসেছিল। পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছিল, বাচ্চারা যে মাঠে খেলতে যেত, সেই মাঠের পাশে একটি টিনের ঘরে বোমা মজুত রাখা হত। বহিরাগতদের আনাগোনাও ছিল সেখানে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, বড়রা তো বটেই, শিশুরাও যাতে ওই ঘরের দিকে না যায়, তা নিশ্চিত করতেই বোমা ছোড়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, এলাকায় আতঙ্ক ছড়ানো। স্থানীয়দেরও অভিযোগ, এলাকায় প্রচুর মেছো ভেড়ি রয়েছে। ওই মেছো ভেড়িগুলিই দুষ্কৃতীদের অন্যতম আড্ডা।
এককালে নরেন্দ্রপুর মফস্সল এলাকা ছিল। দেশভাগের পর ও পার বাংলা থেকে আসা বহু মানুষ এই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। মূল কলকাতা থেকে নরেন্দ্রপুরের দূরত্বও অনেকটাই ছিল তখন। কিন্তু এখন নরেন্দ্রপুর বৃহত্তর কলকাতারই অংশ। নগরায়ণের ‘প্রভাব’ পড়েছে সেখানেও। নরেন্দ্রপুরের এক বাসিন্দা স্বপন চক্রবর্তীর মতে ‘কুপ্রভাব’। তাঁর কথায়, ‘‘নগরায়ণের ফলে নরেন্দ্রপুর এখন পুরোপুরি শহরের চেহারা নিয়েছে। দক্ষিণের শহরতলি, এমনকি, গ্রামবাংলারও বহু মানুষ এখন নরেন্দ্রপুরে এসে থাকছেন। একই ভাবে হয়তো দুষ্কৃতীরাও ঢুকে পড়েছে এখানে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বিবাদ তো রয়েছেই।’’
বারুইপুর পুলিশ জেলার এক আধিকারিকের বক্তব্য, নরেন্দ্রপুরে বাইরে থেকে নিত্যনতুন লোকের আনাগোনা লেগে থাকে। অপরাধীরাও চায় হাজার হাজার লোকের ভিড়ে সহজে মিশে যেতে। তাঁর কথায়, ‘‘আগে নরেন্দ্রপুর এলাকা সোনারপুর থানার অন্তর্গত ছিল। কাজের সুবিধার জন্য বছর তিনেক আগে নরেন্দ্রপুরকে আলাদা থানা ঘোষণা করা হয়। এখন নরেন্দ্রপুর থানা এলাকার মধ্যে রয়েছে রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার ১৭টি ওয়ার্ড এবং সোনারপুর ব্লকের পাঁচটি পঞ্চায়েত। এলাকাটি বিস্তীর্ণ। বাইরের মানুষের আসা-যাওয়া তো রয়েছেই। বহু মানুষ এখানে বাড়ি ভাড়া নিয়েও থাকেন। কিন্তু খোঁজখবর না নিয়ে বা পরিচয়পত্র যাচাই না করেই বাড়ি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছেন মালিকেরা। যা অনেক ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনছে।’’
স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে গড়ে ওঠা নরেন্দ্রপুর ‘অপরাধের মুক্তাঞ্চল’-এ পরিণত হয়েছে বলে দাবি করেছেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের জেলা সম্পাদক আলতাফ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‘রামকৃষ্ণ মিশনের জন্যই নরেন্দ্রপুরের নাম গোটা বাংলা, গোটা দেশ এমনকি, বিশ্বও জানে। কিন্তু এই এলাকার এখন শোচনীয় অবস্থা। আগে এই এলাকায় শিক্ষা-সংস্কৃতির যে পরিবেশ ছিল, তা এখন আর নেই। রোজই নানা রকমের অসামাজিক ঘটনা ঘটছে। অপরাধের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে নরেন্দ্রপুর থানা এলাকা।’’
পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ কলকাতার অদূরে (বর্তমানে দক্ষিণ ২৪ পরগনা) রামকৃষ্ণ মিশনকে কেন্দ্র করে অধুনা নরেন্দ্রপুরের গোড়াপত্তন ঘটে। লোকশিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষকেন্দ্র হিসাবে অচিরেই তা বাংলার দরবারে নিজের জায়গাও করে নেয়। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বামী ইষ্টেশানন্দ মহারাজ বলেন, ‘‘ধীরে ধীরে সেবামূলক কাজ ও পাঠদানে গোটা রাজ্যু জুড়েই এই আশ্রমের নাম ছড়িয়ে পড়ে। আবাসিক বিদ্যালয় ও কলেজের পাশাপাশি লোকশিক্ষার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মানুষকে স্বাবলম্বী করার কাজও করে চলেছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন। এলাকার সাংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে তোলার কাজে আশ্রমের অনেক ভূমিকা রয়েছে।’’
তবে মহারাজও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, নরেন্দ্রপুর মানেই শুধু আশ্রম বা সংলগ্ন এলাকা নয়। নরেন্দ্রপুর থানা এলাকাটি অনেক বড়। তাই এই থানা এলাকার আওতায় অসামাজিক কিছু ঘটলে তার সঙ্গে আশ্রমকে জড়িয়ে ফেলা কখনওই যুক্তিসঙ্গত নয়। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা ভারতেই নানা রকম অসামাজিক কাজকর্ম চলছে। নরেন্দ্রপুর তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। নরেন্দ্রপুর থানা এলাকায় এখন বাইপাস হয়েছে। রাস্তা হয়েছে। মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই হয়তো অসামাজিত কাজকর্ম চলছে। প্রশাসনকে সজাগ থাকতে বলব। তবে আশ্রম আগের মতোই স্বামীজির আদর্শে এবং সেবাকাজে ব্রতী রয়েছে।’’
একই বক্তব্য নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্র তথা পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়েরও। তাঁর কথায়, ‘‘নরেন্দ্রপুর অনেক বড় এলাকা। আশ্রমের অনেকের সঙ্গেই আমার প্রায়ই কথা হয়। আমি যতদূর জানি, আশ্রম বা সংলগ্ন এলাকায় কোনও গন্ডগোল নেই। ওই এলাকার মানুষ শান্তিতেই রয়েছেন।’’ কৌশিকের আরও বক্তব্য, ‘‘নরেন্দ্রপুর এলাকায় অসামাজিক কাজকর্মের কথা বললে তো বোলপুর-শান্তিনিকেতনের কথাও বলতে হয়। দেশ জুড়েই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে হ্যাঁ, আশ্রমের ভিতরে যদি কখনও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে, আমি শঙ্কিত হব।’’
আশ্রমের পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে বিশেষ গন্ডগোল নেই, তা মেনে নিচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারাও। তবে তাঁরা এ-ও জানেন, নরেন্দ্রপুর থানা এলাকার মধ্যে ঘটলে স্বাভাবিক ভাবেই লোকে নরেন্দ্রপুর নিয়ে কথা বলবে। তাই এই নামের ‘মর্যাদা’ রক্ষার দায়িত্ব পুলিশ-প্রশাসনেরই। আশ্রমঘেঁষা গ্রিন পার্ক এলাকার বাসিন্দা অনুভব পাল বলেন, ‘‘অবিলম্বে নরেন্দ্রপুরের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা জরুরি। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কড়া হাতে পদক্ষেপ করতে হবে প্রশাসনকে।’’
তবে বারুইপুর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) জানাচ্ছেন, একটি থানা এলাকায় যেমন অপরাধের ঘটনা ঘটে, নরেন্দ্রপুরের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটছে। তাঁর কথায়, ‘‘এলাকায় প্রচুর অসামাজিক কার্যকলাপ হচ্ছে— এই কথাটা ঠিক নয়। আমরা প্রতি মাসে এলাকায় অপরাধ নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করি। অপরাধের খবর পেলে আমরা তা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখি। বরং আগের চেয়ে অনেক জায়গায় নজরদারি বেড়েছে। পুলিশ-প্রশাসন সজাগই আছে।’’