শুভেন্দু অধিকারীকে নিশানা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। — নিজস্ব চিত্র।
আমার কথা লিখে রাখুন, নন্দীগ্রামে আবার ভোট হবে। ফল বাতিল হবে। বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম আসনে ভোট নিয়ে বার্তা অভিষেকের। আমি আবার ২ মাসের মধ্যে এখানে আসব। বললেন অভিষেক। সুনীল মণ্ডল, এনসি গিরি নামে ঠিকাদার, সরকারি কর্মচারী অনীশ ঘোষের সঙ্গে কার সম্পর্ক? সব তথ্য দলের কাছে আছে। প্রয়োজনে সেই তথ্য সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া হবে। সংবাদমাধ্যম এই তথ্য খতিয়ে দেখতে পারে। আজ এই সভা থেকে ওই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হল। কাঁথির সভায় বললেন অভিষেক। বিকেল ৩টে ৫৪ মিনিটে শেষ হয় অভিষেকের ভাষণ।
শনিবার কাঁথির সভা থেকে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন অভিষেক। তিনি বলেন, ‘‘এই যে ওরা কথায় কথায় বলে, ডিসেম্বর ধামাকা, সরকার পড়ে যাবে। আপনারা জানেন, আমি দরজা যদি খুলে দিই তা হলে দলটা থাকবে না। খালি আপনাদের ভাবাবেগকে সম্মান দিয়েছি। কারণ দুঃসময়ে মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে তৃণমূলের কর্মীরা যে ভাবে লড়াই করেছেন তাঁদের মর্যাদা দিয়ে আমি দরজাটা খুলছি না। যদি দরজা খুলি বিজেপি দল থাকবে না।’’ এর পর তিনি উপস্থিত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের কাছে জানতে চান, ‘‘বলুন, দরজা খুলব? আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, একটু খুলে দিই দরজাটা। আগামী সপ্তাহে খুলি একটু ৫ সেকেন্ডের জন্য? তার পর আবার বন্ধ করে দেব। আমি একটু ছোট্ট করে দরজাটা খুলতে চাই।’’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অভিষেক জানিয়েছেন, যারা প্রায়শ্চিত্ত করে দলের জন্য কাজ করবে তাদের বেছে বেছে তৃণমূলে নেওয়া হবে। তিনি এও জানিয়েছেন, বিজেপি থেকে যারা তৃণমূলে আসতে চলেছে তারা কারও মাথার ওপর বসবে না। তাঁর কথায়, ‘‘সেই দায়িত্ব আমার। আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি।’’
ঘটনাচক্রে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার-সহ দলের অন্যান্য নেতাদের মুখে মুখে বেশ কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে ‘ডিসেম্বর-বার্তা’। তাতে সরকার পড়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারির সঙ্গে মিশে রয়েছে রহস্যও। তবে শনিবার কাঁথির মঞ্চ থেকে অভিষেকের বক্তব্যে নতুন করে জল্পনা তৈরি হল।
যাঁরা ভাবছেন মানুষের কথা না শুনে পঞ্চায়েত চালাবেন তাঁদের আমি হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছি আর এক বার, আপনাদের টিকিট দেওয়া তো দূরের কথা আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে প্রশাসন জেলে ঢোকাবে। এই জেলায় দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। ১৮০ কোটি টাকার টেন্ডার এক জন পেয়েছে। কোনও কাজ হয়নি। আগামিদিনে যারা যোগ্য তারাই দলের প্রথম আসনে বসবে। আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি। যারা পঞ্চায়েতে নয়ছয় করেছে, আমার কাছে খবর আছে প্রধান হওয়ার জন্য ২৫ লক্ষ টাকা, ৫০ লক্ষ টাকা দিয়েছে। এগুলি যদি অক্টোপাসের শুঁড় হয়, অক্টোপাসের মাথাটা ২০০ মিটার দূরে বসে আছে। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। সকলের নামের তালিকা আমার কাছে আছে। তোমরা তৈরি হও। বার্তা অভিষেকের।
আমি আসব। আপনারা ভয় পাবেন না। এই তো বোমা দিয়ে আমাকে চমকানোর চেষ্টা হয়েছিল। আমি এসেছি। কলকাতা থেকে ২ ঘণ্টার রাস্তা। বিজেপির বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একমাত্র লড়ছেন। কিন্তু আমরা থেমে খথাকার পাত্র নই। আমরা আজও মানুষের জন্য লড়াই করতে বদ্ধপরিকর। ডিসেম্বর মাসে বেইমান এবং বিশ্বাসঘাতক পূর্ব মেদিনীপুর গড়ার ডাক দিয়েছে। আগামিদিনে তা সর্বস্তরে করতে হবে। তৃণমূলের বুথ এবং অঞ্চল সভাপতিরা গ্রামে যান। কে কী দল করে তা দেখার দরকার নেই। ভোটে জিতলে আমাদের কোনও জাতিধর্ম নেই। সব পরিষেবা মানুষ পাচ্ছেন কি না তা দেখতে হবে। বার্তা অভিষেকের।
ও তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছে বলে ওই দলের শনি, রাহুর সঙ্গে কেতুর দশাও শুরু হয়েছে। আমাকে চাপ বছর জেলে রাখলে ওর ৪০ বছর জেল হওয়া উচিত। ইডি, সিবিআই এবং বিচেরা ব্যবস্থার অনৈতিক নিরাপত্তা না থাকলে মানুষ এদের ধরে পেটাত। যার মাথা খারাপ তাকে তো ‘গেট ওয়েল সুন’ই বলবে। মাথার ঠিক নেই, পাগল হয়ে গিয়েছে। আজ ঢুকলাম আমাকে ৬ মাস যে বুথে বলবেন সেখানে যাব। মানুষ যাদের সার্টিফিকেট দেবে সেই পঞ্চায়েতে প্রার্থী হবে। চাটুকারিতা করে তৃণমূলের প্রার্থী হওয়া যাবে না। স্পষ্ট বার্তা অভিষেকের।
১০০ দিনের কাজের ৮ হাজার টাকা আটকে দিয়েছে। আবার জনস্বার্থ মামলা করেছে। যখন তৃণমূলে ছিল তখন কেন জনস্বার্থ মামলা করল না? প্রশ্ন অভিষেকের।
আজ ২০০ মিটারের মধ্যে সভা করলাম। এর পরের বার ২০ মিটারের মধ্যে সভা করব। তৃণমূলের সভা নিয়ে শুভেন্দুর আদালতে যাওয়াকে কটাক্ষ অভিষেকের।
আমি পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে গোটা রাজ্যের মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এঁদের বিশ্বাস করার জন্য। আমাদের দোষ রয়েছে ওদের ১০ বছর ক্ষমতা দিয়ে রাখার জন্য। আমাদের নেতাদেরও একটা পরিবারের উপর ভরসা না করে গ্রামে গ্রামে যাওয়া উচিত ছিল। যারা আদর্শ, মূল্যবোধের কথা বলে, তাদের বাড়িতে দুটো তৃণমূলের প্রতীকে জেতা সাংসদ বিজেপির সঙ্গে কানামাছি বৌ বৌ খেলছে। বিবেক, মূল্যবোধ, মর্যাদা, সম্মান থাকলে বিজেপির মঞ্চে যাওয়ার আগে ইস্তফা দিয়ে যেতেন। হোক না নির্বাচন। আমিও চাই। মানুষ প্রমাণ করে দেবেন তাঁরা কাদের সঙ্গে আছেন। আমরা এই বিশ্বাসঘাতকদের পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়া করে ছাড়ব, রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া করে দেব। আমি নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়ে যাচ্ছি। কত ক্ষমতা দেখব। যতদিন না বেইমান মুক্ত করতে পারি তত দিন এই লড়াই চলবে। হুঁশিয়ারি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
কাঁথি ৩ নম্বর ব্লকের মারিশদা ৫ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েত প্রধান ঝুনুরানি মণ্ডল, উপপ্রধান রমাকৃষ্ণ মণ্ডল এবং অঞ্চল সভাপতিকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ। ‘‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারিশদার ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান এবং উপপ্রধানের ইস্তফা চাই। না ইস্তফা দিলে আইনি ব্যবস্থা নেব এবং সরকারকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনুরোধ করব।’’ বললেন অভিষেক।নেতাদের গ্রামে যেতে নির্দেশ। আগামী ১ মাসে ৫০টি গ্রামে যেতে নির্দেশ।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবাধ ভোট হবে। যারা ভোটে লড়তে চায় না তারা নানা টালবাহানা করছে। তোপ অভিষেকের। ২০১১ সালে যা আসন পেয়েছিল তার থেকে ২০১৬ এবং ২০২১ সালে বেশি আসন পেয়েছে তৃণমূল। অধিকারী পরিবার ছিল না বলে আমরা বেশি আসন পেয়েছি। খোঁচা অভিষেকের।কোন রাস্তায় কবে কত টাকা চুরি হয়েছে সব ওঁর মুখস্থ। কারণ উনি এই সবের মাথা। তোপ অভিষেকের। সভাস্থলে যাওয়ার আগে মারিশদার গ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন অভিষেক।
আগামিকাল থেকে ‘বেইমান মুক্ত’ কর্মসূচি পালিত হবে পূর্ব মেদিনীপুরে। ঘোষণা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নির্দেশ দিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতৃত্বকে।
আপনার বাবাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি শিশির অধিকারীকে কোনও দিন অসম্মান করিনি। বয়সের জন্য শ্রদ্ধা করি, কাজের জন্য নয়। এখানে সভা করতে এলেই প্রতিবার ধমকানো-চমকানো হয়। এর আগে আমার উপর আক্রমণ চালানো হয়। জোকার চামচাকে দিয়ে আমাকে সমাজমাধ্যমে আক্রমণ করানো হয়েছিল। তাকে আমি বলেছি, ‘‘তোর বাবাকে গিয়ে বল।’’ কাঁথি অধিকারী গড় নয়। এটা তৃণমূলের গড়। আমি কারও গড়ে আসিনি। পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষের গড়ে এসেছি। আমার কথা শুনবে বলে লেজ গুটিয়ে ডায়মন্ড হারবার পালিয়েছে। তোপ অভিষেকের। যত বার আমার নাম ব্যবহার করবে তত বার অক্সিজেন পাবে। বললেন অভিষেক।
কথায় কথায় আমাকে তোলাবাজ বলে। আমি ৫-৮ ডিসেম্বর দিল্লি যাব। সংসদ আছে। ১৫ দিন সময় দিলাম। এই কলেজ মাঠে আবার সভা হবে। তুমি তোমার খাতা নিয়ে আসবে। আমি আমার খাতা নিয়ে আসব। আমাদের মধ্যে দুর্নীতি ইস্যুতে লড়াই হবে। আমি ওদের উলঙ্গ করে দেব। শুভেন্দুকে চ্যালেঞ্জ অভিষেকের।
এই মাঠে আমার সভা নিয়ে ও আদালতে গিয়েছে। সকাল, বিকেল, শয়নে, স্বপনে আমার নাম করছে। কিন্তু সরাসরি আমার নাম নিতে পারে না। বলে, ভাইপো। এই রাজ্যের সবচেয়ে বড় তোলাবাজ, ঘুষখোরের নাম কী? টিভির পর্দায় কাকে ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছে? সুদীপ্ত সেন কার নামে চিঠি দিয়েছে? এই কলেজের গার্লস হস্টেল হচ্ছিল ২০১৫ সালে। ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার টেন্ডার হয়েছিল। তাতে ৮৫ লক্ষ টাকা বেশি দেওয়া হয়েছিল। গার্লস কলেজের পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান কে ছিলেন? তাঁরাও এই সভা শুনছেন। কেউ মোবাইলে, কেউ মাইকে শুনছে। ২০০ মিটার দূরে তো বাড়ি। এদের কাছে সততার পাঠ তৃণমূল শিখবে না। তোপ অভিষেকের।
পূর্ব মেদিনীপুরের এই বিশ্বাসঘাতককে আগামী ৫০০ বছর মিরজাফর, গদ্দার বলে ডাকবে। বিশ্বাসঘাতক এবং বেইমান মুক্ত মেদিনীপুরের মাটি চাই। শুভেন্দুকে নিশানা অভিষেকের। তাঁর আক্রমণ, ‘‘যার পরিবার ব্রিটিশ তাড়ায় সে অমিত শাহের পায়ে হাত দিয়ে বিজেপিতে যোগ দেবে?’’
সাধারণ মানুষ যে ভাবে তৃণমূলকে দেখতে চায়, আমরা সেটা করতে বদ্ধপরিকর। আমরা ঠিকাদারদের মতো করে পার্টিকে গড়তে বদ্ধপরিকর নই। বার্তা অভিষেকের। শহিদ ক্ষুদিরাম বসু আকাশের দিকে বুক চিতিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। আর সেই পূর্ব মেদিনীপুরের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করে ইডি, সিবিআই থেকে বাঁচতে বিজেপির নেতাদের পা ধরে দু’বছর আগে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিল তাকে এই জেলার মানুষ ক্ষমা করবে না। শুভেন্দুকে আবার নাম না করে তোপ অভিষেকের।
মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উপস্থিত হয়েছেন সভা। এর থেকে অনেক বেশি মানুষ রাস্তায় আছেন। পূর্ব মেদিনীপুরে সভা করলে জায়গা ছোট হয়ে যায়। বললেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা নির্বাচনের সময় সভা করার স্মৃতিচারণ অভিষেকের। মমতা যাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে বিশ্বাসঘাতক, বিজেপির পা ধরেছে, শুভেন্দুকে নাম না করে তোপ অভিষেকের।
কাঁথির সভায় তুমুল ভিড় সমর্থকদের। বেলা ৩টে ১০ নাগাদ কাঁথির ওই মঞ্চে পৌঁছন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শহিদ ক্ষদিরাম বসুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন তিনি। অভিষেককে দেখে তুমুল উৎসাহের ছবি দেখা যায় কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে। মঞ্চে উঠে দলীয় কর্মী এবং সমর্থকদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা বার্তা দেন তিনি। অভিষেককে ফুল দিয়ে বরণ করেন কাঁথি জেলা তৃণমূলের সভাপতি তরুণকুমার মাইতি। বিকেল ৩টে ২০ নাগাদ বক্তৃতা শুরু করেন অভিষেক।
সভামঞ্চ থেকে বক্তৃতা তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের। শুভেন্দু বিজেপির জুতো পালিশ করতে গিয়েছে বলে কটাক্ষ করেন কুণাল। শুভেন্দুকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ‘কলঙ্ক’ বলেও খোঁচা দেন তিনি।
ভিড়ের জেরে কাঁথি শহরের যান চলাচল থমকে গিয়েছে। মূলত যে রাস্তা ধরে বিভিন্ন মিছিল এগোচ্ছে সেই রাস্তা দিয়ে কোনও গাড়ি আসা-যাওয়া করতে পারছে না। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, সভায় ভিড়ের যা লক্ষ্যমাত্রা ছিল ছাপিয়ে গিয়েছে। এখনও অনেকে সভাস্থলের উদ্দেশে যাচ্ছেন বলে তাঁদের দাবি।