যন্তর মন্তরে চাকরিহারাদের অবস্থানে এক শিক্ষকের গলায় চাল, কালো ডাল ও চালে-ডালে মেশানো থলি। দাবি, চাল-কালো ডালের মতো যোগ্য আর দাগিদের আলাদা করা হোক। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
আর জি কর হাসপাতালের নির্যাতিতার বাবা-মা দিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে অনুরোধ জানালেও কোনও জবাবই মেলেনি। তাঁরা দিল্লিতে এসে শুধু সিবিআই অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করে ফিরে যান।
এ বার পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির ফলে চাকরিহারা রাজ্যের যোগ্য শিক্ষকরাও দিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রীর দেখা পেলেন না। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দেখা করার অনুরোধ জানালেও জবাব মিলল না। বুধবার দুপুরে দিল্লির যন্তর মন্তরে ঘণ্টা তিনেক ধর্নায় বসে প্রধানমন্ত্রী দফতর, রাষ্ট্রপতি ভবনের দফতর ও কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে স্মারকলিপি দিয়েই তাঁদের ফেরার বাস ধরতে হল।
প্রধানমন্ত্রীর দেখা না মিললেও চাকরিহারা শিক্ষকরা এখন বৃহস্পতিবারের সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার চাকরি বাতিল হয়েছিল। সেই রায় পর্যালোচনার জন্য রাজ্য সরকার, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা স্কুল সার্ভিস কমিশন এখনও সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানায়নি। তবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ রায়ে সামান্য বদল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে, যে সব নির্দোষ, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই, যাঁদের চাকরি গেলেও বেতন ফেরত দিতে হবে না বলে সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়েছে, তাঁদের চলতি শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত বা যত দিন না নতুন নিয়োগ হচ্ছে, তত দিন চাকরিতে বহাল রাখা হোক। সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে বৃহস্পতিবার এই আবেদনের শুনানি হবে।
প্রায় ৪০ ঘণ্টার বাসযাত্রা শেষে বুধবার সকালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৬০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা দিল্লি পৌঁছন। রাস্তায় যেখানে বাস থেমেছে, সেখানেও নিজেদের পরিস্থিতির কথা জানিয়ে প্যামফ্লেট বিলি করেছেন তাঁরা। দুপুর থেকে তাঁরা যন্তর মন্তরের ফুটপাতে ধর্নায় বসেন। সেখান থেকেই চিন্ময় মণ্ডলের মতো শিক্ষকরা চেষ্টা করছিলেন, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির দেখা না মিললেও যদি তাঁদের দফতরে স্মারকলিপি পৌঁছে দেওয়া যায়। শেষে নিরাপত্তাকর্মীদের চেষ্টায় কয়েক জন গিয়ে স্মারকলিপি পৌঁছে দেন। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর আগামী সপ্তাহে কল্যাণীতে এমসের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। সেখানেও তাঁরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন। ঘটনাচক্রে এ দিনই ২৬ হাজারের চাকরি বাতিলের প্রসঙ্গে কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে!’’
যন্তর মন্তরের ধর্নায় স্কুল শিক্ষক তন্ময় হালদার বসেছিলেন গলায় তিনটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঝুলিয়ে। একটি প্যাকেটে শুধু চাল। অন্যটিতে কালো ডাল। তৃতীয় প্যাকেটে চাল ও ডাল মেশানো। চাকরি হারিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়া চার বছরের মেয়ের বাবা তন্ময়ের দাবি, এই চাল ও কালো ডালের মতো করে যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও দাগি-দের আলাদা করতে হবে। পাথরপ্রতিমা আনন্দলাল আদর্শ বিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী সুজয় সর্দার বলছিলেন, স্কুলে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন বলে অন্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সুযোগ পেলেও সে দিকে এগোননি। এখন কী হবে? ছেলের বয়স তিন বছর হবে। তাকে স্কুলে ভর্তি করার টাকা জোগাবে কে?
পূর্ব মেদিনীপুরের স্কুল শিক্ষক রতন বারিকের প্রশ্ন, ‘‘শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হলে স্কুলে ছেলেমেয়েদের কী ভাবে ভাল করে পড়াশোনা করায় উৎসাহ দেব?’’ রসায়নের শিক্ষিকা শিল্পা বসু বলছিলেন, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি হারিয়েছেন। সরকার বলছে, আবার পরীক্ষা হবে। আবার দুর্নীতি হবে না, তার নিশ্চয়তা কী! অনিন্দিতা চৌধুরী জানান, তাঁর স্কুলে তিনি একাই জীববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর চাকরি যাওয়ায় ক্লাসই হচ্ছে না। মুর্শিদাবাদের শরিফা খাতুনের সঙ্গে তাঁর দাদা, বৌদি, মাসতুতো দিদির চাকরি গিয়েছে। শরিফার হতাশার কারণ, বাবা, মা শিক্ষকতা করতেন বলে তাঁর দাদা অন্য সরকারি চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিয়ে স্কুলে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখন কী হবে? এমনই সব প্রশ্ন নিয়ে সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে ফেরার বাস ধরলেন চাকরিহারা যোগ্যেরা। যন্তর মন্তরের ফুটপাতের ধুলোয় শুধু কিছু চোখের জল শুকিয়ে লেগে রইল।