Primary Recruitment Case

‘কাকু’কে প্রার্থীদের তালিকা ইমেল করেন লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের রিসেপশনিস্ট! চার্জশিটে সিবিআই-দাবি

প্রাথমিক মামলার তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে সিবিআই। সেখানেই লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের মহিলা রিসেপশনিস্টের নাম উঠে এসেছে। তিনি অযোগ্যদের তালিকা ‘কাকু’কে পাঠিয়েছিলেন।

Advertisement
সারমিন বেগম
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৯:০১
Receptionist of Leaps and Bounds sent an email containing list of un-qualified candidates to Sujay Krishna Bhadra

লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের রিসেপশনিস্ট ইমেলে প্রার্থিতালিকা পাঠিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তদন্তে প্রথম থেকেই উঠে এসেছিল লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের নাম। ওই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’। সিবিআই ইতিমধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে। সেই চার্জশিটে তারা দাবি করেছে, লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের মহিলা রিসেপশনিস্ট সুস্মিতা চক্রবর্তী ‘অযোগ্য’ প্রার্থীদের নামের তালিকা ইমেল করেছিলেন ‘কাকু’কে। মোট ১৫৭ জনের নাম পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ৫১ জনের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে চাকরি হয়েছে বলে সিবিআইকে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। প্রসঙ্গত, প্রাথমিকে নিয়োগ মামলায় সুজয়কৃষ্ণ ওরফে ‘কাকু’ অন্তর্বর্তী জামিন পেয়েছেন। তিনি আপাতত বেহালায় নিজের বাড়িতেই রয়েছেন।

Advertisement

মহিলা রিসেপশনিস্টের ইমেল

গত ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক নিয়োগ মামলার তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে সিবিআই (তার প্রতিলিপি আছে আনন্দবাজার অনলাইনের হেফাজতে)। সেই চার্জশিটে সিবিআই জানিয়েছে, অরুণ হাজরার (যিনি এখন বিজেপি নেতা) এজেন্ট দয়াল সাহা প্রথমে ১৫৭ জন ‘অযোগ্য’ চাকরিপ্রার্থীর নামের তালিকা রিসেপশনিস্ট সুস্মিতাকে ইমেলে (পিওপি... @জিমেল.কম) পাঠিয়েছিলেন। সুস্মিতা সেই তালিকা সুজয়কৃষ্ণের ইমেল আইডিতে (এসইউজেএ....@জিমেল.কম) পাঠিয়ে দেন। সিবিআই তদন্ত করে দেখেছে, ওই তালিকা তার পরে সুজয়কৃষ্ণের কাছ থেকে গিয়েছিল অধুনা বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের কর্মচারী অরবিন্দ রায় বর্মণের কাছে। অরবিন্দ আবার তালিকাটি পাঠান দীপক কুমার বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তিকে। ওই ১৫৭ জন ‘অযোগ্য’ প্রার্থীর মধ্যে ৫১ জন চাকরি পেয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সচিব নিজেই সেই তথ্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, এই মামলায় মহিলা রিসেপশনিস্ট সুস্মিতার বয়ানও রেকর্ড করেছে সিবিআই।

লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসেও কয়েক কোটি!

সিবিআই চার্জশিটে লিখেছে যে, তারা তদন্তে জানতে পেরেছে, কুন্তলের কাছ থেকে ‘অযোগ্য’ প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। তাঁর বেহালার বাড়ি এবং নিউ আলিপুরে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের দফতরে এই টাকা পাঠানো হয়েছিল। সুজয়কৃষ্ণ ছিলেন লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও)। চার্জশিটে সুজয়কৃষ্ণের ওই পরিচয় দিয়ে সিবিআই দাবি করেছে, এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছ’কোটি টাকা কুন্তল নিজে সুজয়কৃষ্ণকে দিয়েছিলেন। তৃণমূল নেতা (এখন বহিষ্কৃত) শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আগে থেকেই চিনতেন সুজয়কৃষ্ণ। তাঁর মাধ্যমেই কুন্তলের সঙ্গে সুজয়কৃষ্ণের আলাপ। শুধু প্রাথমিকে শিক্ষকতা নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন পদে বেআইনি নিয়োগের সিন্ডিকেট চালাতেন তাঁরা। চার্জশিটে এমনই দাবি করেছে সিবিআই।

ঘুষের এক কোটি!

চার্জশিটে সিবিআইয়ের দাবি, চারটি পৃথক ইমেলে মোট ৮৫ জন ‘অযোগ্য’ প্রার্থীর নামের তালিকা সুজয়কৃষ্ণ পাঠিয়েছিলেন অরবিন্দকে। একই ভাবে সেগুলি পৌঁছোয় দীপকের কাছেও। তাঁদের মধ্যে চাকরি পেয়েছেন ১০ জন। চার্জশিটে সিবিআই জানিয়েছে, সুজয়কৃষ্ণের দুই এজেন্টের নাম অমিতাভ দত্ত এবং অনিরুদ্ধ হালদার। তাঁরা ওই ৮৫ জনের কাছ থেকে অগ্রিম হিসাবে প্রায় এক কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। টাকার বদলে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ওই ৮৫ জনকে।

সুজয়কৃষ্ণের অডিয়ো

প্রাথমিকে নিয়োগ মামলার তদন্তে সুজয়কৃষ্ণের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করেছে সিবিআই। তারা প্রথম থেকেই দাবি করছিল, একটি বিশেষ অডিয়ো ক্লিপ তাদের কাছে আছে। যা এই তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। সেই কারণে সুজয়কৃষ্ণের কণ্ঠস্বরের নমুনা প্রয়োজন। ওই অডিয়োতে সুজয়কৃষ্ণ, কুন্তল, শান্তনুর কথোপকথন শোনা গিয়েছে বলেও চার্জশিটে সিবিআই দাবি করেছে। ওই চার্জশিট অনুযায়ী, অডিয়োয় সুজয়কৃষ্ণকে বলতে শোনা গিয়েছে, বেআইনি নিয়োগের জন্য জনৈক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৫ কোটি টাকা চেয়েছেন। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মানিক ভট্টাচার্যের নামও উল্লেখ করতে শোনা গিয়েছে ওই অডিয়ো ক্লিপে। তদন্তের সাপেক্ষে সিবিআই চার্জশিটে দাবি করেছে, সুজয়কৃষ্ণ, শান্তনু এবং কুন্তল আরও দু’হাজার ‘অযোগ্য’ প্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার ছক কষেছিলেন। মোট ১০০ কোটি টাকা তুলে সেখান থেকে পার্থ, অভিষেক এবং মানিককে ২০ কোটি করে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, চার্জশিটের খবর বুধবার সকালে প্রথম আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার পরেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবী সঞ্জয় বসু বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, সিবিআই তাঁর মক্কেলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চক্রান্ত করছে। তাঁর মক্কেল ইডি এবং সিবিআই-কে তদন্তে ‘পূর্ণ সহযোগিতা’ করেছেন। দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যখনই তাঁকে তলব করেছে, তখনই তিনি উপস্থিত হয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্রও সরবরাহ করেছেন। কিন্তু তার পরেও সিবিআই ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগ করছে। অভিষেকের আইনজীবী সঞ্জয়ের বিবৃতি বলেছে, ‘‘মামলার তদন্তকারী সংস্থা ইডি আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে কোনও চার্জশিট দাখিল করেনি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের কোনও উপাদানের উপস্থিতিও মেলেনি। তার পরেও তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিট আমার মক্কেলকে হয়রানির উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছু নয়।’’ অভিষেকের তরফে এ-ও দাবি করা হয়েছে যে, সিবিআই তাদের দাবির ‘সমর্থনযোগ্য’ কোনও নথি বা প্রমাণ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, অন্যায় ভাবে অভিষেককে ‘টার্গেট’ করা হচ্ছে।

তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের তরফে পাল্টা অভিযোগ করা হয়েছে, ‘ইডিকে কাজে লাগিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পরে একটি রাজনৈতিক শক্তি সিবিআইয়ের দিকে ঝুঁকেছে। স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির অপব্যবহার করছে। সংশ্লিষ্ট চার্জশিটে প্রমাণের স্পষ্ট অভাব থাকা সত্ত্বেও সন্দেহ (অভিষেককে নিয়ে) তৈরি করার একটি মরিয়া প্রচেষ্টা করা হয়েছে।’ অভিষেকের আইনজীবী সঞ্জয়ের বিবৃতির শেষে বলা হয়েছে, অভিষেক সত্য এবং ন্যায়ের পথে চলবেন। তিনি কোনও ভিত্তিহীন অভিযোগে ভীত নন। সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে সততা রক্ষা এবং ন্যায়বিচারের জন্য নিরলস ভাবে লড়াই করবেন অভিষেক।

Advertisement
আরও পড়ুন