— প্রতীকী চিত্র।
একটি মেরুন ডায়েরি। তাতে আপাত ভাবে দুর্বোধ্য সাঙ্কেতিক ভাষায় বিস্তর হিসেব-নিকেশ। রেশন বণ্টন দুর্নীতির মামলায় জেল হেফাজতে থাকা প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের আপ্ত সহায়ক অভিজিৎ দাসের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সেই ডায়েরিই এখন তদন্তের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে ইডির গোয়েন্দাদের সূত্রে দাবি উঠে আসছে। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির শাখা-প্রশাখার নানা সূত্র ওই ডায়েরির পাতায় লুকিয়ে বলে সূত্রটি দাবি করছে।
সম্প্রতি জ্যোতিপ্রিয় ঘনিষ্ঠসুব্রত ঘোষ ও হৃতেশ চন্দক নামে দুই চাল কলের মালিক এবং শান্তনু ভট্টাচার্য নামের জ্যোতিপ্রিয় ঘনিষ্ঠ এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে গ্রেফতার করেছে ইডি। ওই তিন জনই এখন ইডির হেফাজতে। এই তিন মূর্তি জ্যোতিপ্রিয় নিয়ন্ত্রিত রেশন বণ্টন দুর্নীতি চক্রের একটি সিন্ডিকেটের অংশ বলে তদন্তে উঠে এসেছে। সাঙ্কেতিক ভাষায় অজস্র ভুয়ো চাষি বা ভুয়ো সংস্থার নামের আদ্যক্ষর লিখে এই সিন্ডিকেটের আর্থিক লেনদেনের খুঁটিনাটি মেরুন ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ বলে ইডির তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। অভিজ্ঞ চোখেই ওই সাঙ্কেতিক ভাষা বোধগম্য হবে বলে তদন্তকারীদের সূত্রে ব্যাখ্যা। এমনকি, দুবাইয়েও দুর্নীতির টাকা সরানো হয় বলে স্থানীয় প্রশাসনের মারফত জানা গিয়েছে বলে ইডির তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ২০২৩ সালের অক্টোবরে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক অভিজিৎ দাসের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে মেরুন রঙের ডায়েরিটি উদ্ধার করা হয়েছিল। তার পাতায় পাতায় রেশন বণ্টন কেলেঙ্কারির সিন্ডিকেটের কারবারের ফিরিস্তি লেখা বলে সব কিছু ক্রমশ প্রকাশ্যে এসেছে। অভিজিৎকে দফায় দফায় তলব করে ডায়েরির সাঙ্কেতিক ভাষার পাঠোদ্ধার করা হয়। এর পরেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির আভাস উঠে আসে বলে তদন্তকারীদেরসূত্রে দাবি।
ইডির এক কর্তার কথায়, “চাষিদের কাছ থেকে রাজ্য সরকারের ধান কেনার সহায়ক মূল্যের কোটি কোটি টাকা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নির্দেশে কী ভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছিল, সেটাই ওই ডায়েরির পাতায় সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা। ক্রমশ সব পরিষ্কার হচ্ছে।” দীর্ঘ এক দশক (২০১১ থেকে ২০২১) রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেট রাজ্য সরকারি তহবিলের কোটি কোটি টাকা লুটে সক্রিয় ছিল বলেই তদন্তকারীদের হাতে আসা নানা সূত্র মারফতআভাস মিলেছে।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ভুয়ো চাষিদের নামে কয়েক হাজার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। ওই ‘চাষিদের’ কাছ থেকে কোনও ধান কেনাই হয়নি। কিন্তু ধান কেনার কথা বলে রাজ্য সরকারের ধান কেনার সহায়ক মূল্য ওই সব নামকাওয়াস্তে চাষির কয়েক হাজার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বছরের পর বছর সরাসরি জমা হয়েছে বলে তদন্তকারীদের সূত্রের দাবি। এখানেই শেষ নয়! ডায়েরির পাতা সঙ্কেতের মোড়কে বলছে, ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে ওই সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ টাকা তুলে নানা সংস্থায় পাচার করা হয়েছে।
তদন্তকারীদের সূত্রটি বলছে, ইডির হেফাজতে ধৃত দুই চালকল মালিক সুব্রত এবং হৃতেশ ভুয়ো অ্যাকাউন্টে সরকারি টাকা জমায় জড়িত এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট শান্তনু সেই টাকা সরানোয় করিৎকর্মা বলে ইডির তদন্তে প্রকাশ। তদন্তকারীদের সূত্রের দাবি, জ্যোতিপ্রিয় এবং তাঁর পরিবারের লোকেদের অধীনস্থ তিনটি সংস্থায় লুটের টাকার একটি বড় অংশ জমা হয়েছে। জ্যোতিপ্রিয়ের স্ত্রী ও কন্যার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও সরকারি রাজকোষের লুটের টাকা জমা হয়েছে বলে তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। তদন্তকারীদের ওই সূত্র বলছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা কয়েক কোটি টাকার উৎসের কোনও সন্ধান দিতে পারেননি জ্যোতিপ্রিয়ের স্ত্রী ও কন্যা। তাঁদের দু’জনকে কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু কোনও সদুত্তর মেলেনি।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ভুয়ো চাষি পরিচয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়া সরকারি টাকা হাওয়ালা মারফত নগদে বিদেশেও পাচার হয়েছে এবং বিদেশে নানা সংস্থা খুলে ওই টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বলেওতথ্য মিলেছে।
রেশন বণ্টন দুর্নীতি চক্রে সুব্রত, হৃতেশ এবং শান্তনুর মতো একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল বলে ইডির তদন্তকারীদের সূত্রের দাবি। ধৃতদের জেরা করে রেশন দুর্নীতির টাকার গতিবিধি বোঝার চেষ্টা চলছে বলে তদন্তকারীরা জানান।