সরাসরি বিজেপি না থাকলেও, নেপথ্যে রয়েছেন পদ্মশিবিরের দুই নেতা। —ফাইল চিত্র।
২০২১ সালের ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘বাঙালি অস্মিতা’র ভাষ্য তৈরি করেছিল তৃণমূল। ২০২৪ সালের ভোটেও শাসকদলের স্লোগান ছিল, ‘জনগণের গর্জন, বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন।’ খুব নাটকীয় কোনও বদল না ঘটলে ২০২৬ সালেও শাসক তৃণমূল এই ‘ধারা’ই বজায় রাখবে। সেটা আন্দাজ করেই পাল্টা ‘ভাষাগত’ সংখ্যালঘুদের এক ছাতার নীচে রাখার পরিকল্পনা করছে বিজেপি। আগামী রবিবার ধর্মতলায় একটি সমাবেশের ডাক দিয়েছে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যাঙ্গুইস্টিক মাইনরিটিজ় অ্যাসোসিয়েশন’, যেখানে থাকার কথা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীরও।
সরাসরি বিজেপির নামে কর্মসূচি না-হলেও এর নেপথ্যে যে পদ্মশিবির রয়েছে, তা স্পষ্ট। কারণ, এই সংগঠনের মূল দুই উদ্যোক্তা ব্যারাকপুরের প্রাক্তন সাংসদ অর্জুন সিংহ এবং আসানসোলের বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক জিতেন্দ্র তিওয়ারি। ঘটনাচক্রে দু’জনেই অবাঙালি। দু’জনে দু’টি শিল্পাঞ্চলের নেতা। আবার দু’জনেই বিজেপির অন্দরে শুভেন্দুর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত। বিজেপি পরিষদীয় দল সূত্রে খবর, সভায় যোগদান করবেন বলে ইতিমধ্যেই উদ্যোক্তাদের আশ্বস্ত করেছেন শুভেন্দু, যিনি নিজে বাঙালি নেতা।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, ভাষার ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার ষড়যন্ত্র করছে তৃণমূল। অর্জুনের বক্তব্য, ‘‘কিছু সংগঠন বাঙালি-অবাঙালি ভেদাভেদ করতে চাইছে। বহু ক্ষেত্রে এই বিভেদের রাজনীতির ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা প্রকাশ্যে চলে আসছে। অনেক স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি পড়ানো হত। সেটা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তাই আমরা সেই বিভাজনের বিরুদ্ধে পথে নামছি। আগামী দিনেও আমাদের প্রতিবাদ জারি থাকবে।’’
শুভেন্দু একটা কথা বার বার বলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘বাঙালি-অবাঙালি’ আখ্যান তৈরি করে আসলে তৃণমূল হিন্দুদের বিভাজিত করে রাখতে চায়। যা থেকে স্পষ্ট, শুভেন্দুরা চান হিন্দু ভোট এক জায়গায় আসুক। অন্য দিকে, গত ১৫ বছর ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভোট বাংলায় তৃণমূলের দখলে রয়েছে, ক্রমে যা শাসকদলের পুঁজিতে পরিণত। তৃণমূলের দখলে যখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভোট, তখন ভাষাগত সংখ্যালঘুদের এক ছাতার নীচে আনার চেষ্টা শুরু করছে বিজেপি। উল্লেখ্য, হুগলি, ব্যারাকপুর, বর্ধমান, হাওড়ার শিল্পাঞ্চল এবং কলকাতার বন্দর এলাকা-সহ বিভিন্ন জনপদে এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, যাঁরা হিন্দিভাষী এবং উর্দুভাষী মুসলিম। অর্থাৎ তাঁরা ধর্মীয় এবং ভাষাগত— দু’দিক থেকেই ‘সংখ্যালঘু’। সেই অংশকে ছুঁয়ে তৃণমূলের পুঁজিতে আঘাত হানার কৌশল নিয়েও বিজেপির সলতে পাকানোর অবকাশ রয়েছে।
তবে এর পাল্টা অভিমতও রয়েছে। তা হল, যাঁরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাঁরা কি কেবলমাত্র ভাষার কারণে বিজেপির দিকে যাবেন? কারণ, এখনও পর্যন্ত বিজেপির রাজনীতির মূল অভিমুখ হিন্দুত্বই। অন্তত সাধারণ ধারণা তা-ই। কারণ, বঙ্গ রাজনীতিতে তৃণমূলের বিরোধিতায় হিন্দুত্বের বাইরে নতুন কোনও রাজনৈতিক আখ্যান তৈরি করতে পারেনি পদ্মশিবির। ফলে তৃণমূল যতই বাঙালি অস্মিতার রাজনীতি করুক, হিন্দিভাষী অথচ ধর্মীয় ভাবে সংখ্যালঘুদের ভোট এখনই শাসকদলের থেকে সরে যাবে, তেমন কোনও বাস্তবতা নেই।
আবার বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌশলী চালে ‘দিগ্ভ্রান্ত’ হচ্ছে। সম্প্রতি যা দেখা গিয়েছে দিঘায় নির্মীয়মাণ জগন্নাথ মন্দির পরিদর্শনে মমতার সফর ঘিরে। বাংলাদেশে ইসকনের সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতরি নিয়ে এ পার বাংলায় নতুন করে হিন্দু ঐক্য গড়তে আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছিলেন শুভেন্দুরা। কিন্তু দিঘার মন্দির পরিদর্শনের সময় মমতার পাশে ছিলেন কলকাতার ইসকনের প্রধান সেবায়েত রাধারমণ দাস। মমতার বিরোধিতা করতে গিয়ে সেই রাধারমণের সমালোচনা করে বসেন শুভেন্দু। তা-ও আবার শুভেন্দুর জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে। একে অনেকেই ‘মমতার মাস্টারস্ট্রোক’ বলে অভিহিত করেছেন। বিজেপির-ও অনেক নেতা একান্ত আলোচনায় বলেছেন, তৃণমূল যা করবে, সেই সব কিছুর বিরোধিতা করতে গেলে এমন হবেই। তাতে ধ্রুপদী অস্ত্রও (হিন্দুত্ব) ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। পরোক্ষে শক্তিশালী হতে পারে তৃণমূল।
ভিন্রাজ্য থেকে আসা বিজেপি নেতাদের বাংলা উচ্চারণ, মনীষীদের জন্মদিন গুলিয়ে ফেলা ইত্যাদিকে তৃণমূল ‘বাংলা বিরোধী’ হিসাবে অভিহিত করে থাকে। বিজেপি দলীয় পরিসরে যে ধরনের (কর্মীদের ‘কার্যকর্তা’, স্বাগতমকে ‘স্বোয়াগতম’, প্রণাম বা নমস্কারকে ‘নমন’) শব্দ বলে, তা-ও বাংলার সংস্কৃতির পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে রাজ্যের শাসকদল। সেই প্রেক্ষাপটেই বিজেপি ভাষাগত সংখ্যালঘুদের এককাট্টা করতে চাইছে। আবার এ-ও বাস্তব যে, তৃণমূলের সার্বিক রাজনীতিতে বাঙালি অস্মিতা থাকলেও মমতার সরকারই ছটপুজোয় রাজ্যে দু’দিন ছুটি ঘোষণা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে তক্তাঘাট এবং দইঘাটে ছটপুজোর উদ্বোধনেও যান, যা মূলত অবাঙালিদেরই উৎসব।
এ হেন রাজনীতির ভাষ্য-পাল্টা ভাষ্য তৈরির মহড়ায় একটা বিষয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আপাতত বঙ্গ রাজনীতি আবর্তিত হবে মেরুকরণের কক্ষপথেই। কখনও ধর্মীয়, কখনও ভাষাগত।