Anubrata Mondal

নেতা বেছে নিয়ে দরজা খুললেন কেষ্ট, ফিরতে হল সাংসদ-মন্ত্রী-বিধায়কদের, নেপথ্যে সেই ‘গোষ্ঠী-ব্রত’!

কৌতূহলের বিষয় হল, কেন একাংশকে ভিতরে ঢোকার প্রবেশাধিকার দিলেন অনুব্রত? বাকিদের দিলেন না? এই প্রশ্নেই নানা ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০১
Few leaders met Anubrata Mondal, many did not allow entry inside his home

অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: পিটিআই।

অনুব্রত মণ্ডল অ্যাকশন ছবির ভক্ত। একটা সময়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘‘যে বইয়ে (ছবিতে) অ্যাকশন নেই, সেটা আবার বই নাকি!’’ সেই অনুব্রত জেল থেকে দু’বছর পর মঙ্গলবার সকালে বাড়ি ফিরেছেন। তার পর যা ঘটালেন, তা দেখে বীরভূমের তৃণমূলের অনেক নেতা হিন্দি অ্যাকশন ছবির সংলাপ ধার করে বলছেন, ‘‘সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়!’’ অর্থাৎ, বুদ্ধিমানদের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট।

Advertisement

অনুব্রত ‘কেষ্ট’ মণ্ডল বাড়িতে ঢুকেই বসেছিলেন তাঁর বাসভবনের অফিসে। যে চেয়ারে বসে একটা সময়ে বীরভূম জেলা চালাতেন তিনি। কিন্তু কেষ্টর সামনে দলের সব নেতা যেতেই পারলেন না। কেউ কেউ পারলেন। কাউকে কাউকে ফিরতে হল দুয়ার থেকে। যাঁরা প্রবেশাধিকার পেলেন আর যাঁরা পেলেন না, তাঁদের তালিকা দেখে অনেকেই বলছেন, জেলায় ফিরেই দলীয় রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের জন্ম দিয়ে দিলেন অনুব্রত। বীরভূম তৃণমূলের অনেক নেতাই একান্ত আলোচনায় বলছেন, ‘বার্তা’ দিয়ে দিয়েছেন অনুব্রত। বার্তা এই মর্মে যে, তাঁর সঙ্গেই জেলার রাজনীতিতে তাঁর আমলের ‘গোষ্ঠী-ব্রত’ ফিরে এসেছে।

অনুব্রতের সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে পেরেছেন, সেই তালিকায় উল্লেখযোগ্য নাম নলহাটির তৃণমূল বিধায়ক রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ, বোলপুর পুরসভার চেয়ারপার্সন পর্ণা ঘোষ এবং পর্ণার স্বামী তথা জেলা তৃণমূলের অন্যতম নেতা সুদীপ্ত ঘোষ। কিন্তু যাঁদের দুয়ার থেকে ফিরে আসতে হয়েছে, সেই তালিকা আরও লম্বা এবং ওজনদার।

মঙ্গলবার বোলপুরে প্রশাসনিক বৈঠক ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই সভায় যাওয়ার আগেই অনুব্রতের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ এবং সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী। তৃণমূলের অনেকেরই দাবি, চন্দ্রনাথকে ভিতরে ঢুকতে দেননি কেষ্ট। যদিও চন্দ্রনাথ আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে দাবি করেছেন, তিনি অনুব্রতের সঙ্গে দেখা করেছেন। কথাও বলেছেন। মমতার প্রশাসনিক সভার পরে বোলপুরের তৃণমূল সাংসদ অসিত মাল, ময়ুরেশ্বরের বিধায়ক অভিজিৎ রায়, মুরারইয়ের বিধায়ক মোশারফ হোসেনরা অনুব্রতের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ফিরতে হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের বিধায়ক অপূর্ব চৌধুরীকেও মণ্ডলবাড়ির দরজা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে।

কেন দলের একাংশকে প্রবেশাধিকার দিলেন অনুব্রত? কেন বাকিদের দিলেন না? নানা ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে। শাসকদলের একটি অংশের বক্তব্য, অনুব্রত জেলে যাওয়ার আগে চন্দ্রনাথ এবং বিকাশের সঙ্গে তাঁর ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছিল। তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে মঙ্গলবার। জেলা তৃণমূলের অন্য একটি অংশ এ-ও বলছে, অনুব্রত আসানসোল জেলে থাকার সময়ে অনেক নেতাই নিয়মিত সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। কিন্তু দিল্লির তিহাড় জেলে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পরে প্রথম সারির কোনও নেতাই প্রায় যোগাযোগ রাখেননি। যাঁরা ‘পাশে’ ছিলেন, তাঁরাই মঙ্গলবার কেষ্টর অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন।

জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘জেলা পরিষদের প্রাক্তন এক কর্মাধ্যক্ষ দিল্লিতে ধারাবাহিক ভাবে যাতায়াত করেছেন। যাঁকে দল গত পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট দেয়নি। কিন্তু তিনি কেষ্টদার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করেননি। আমার মনে হয়, সেই নেতার চোখ দিয়েই দাদা আপাতত পুরোটা দেখছেন।’’ জেলে যাওয়ার পরেও অনুব্রতকে জেলা সভাপতির পদ থেকে সরাননি দলনেত্রী মমতা। জেলার সাংগঠনিক কাজ পরিচালনার জন্য মমতা একটি ‘কোর কমিটি’ তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকের বক্তব্য, ‘অনুব্রতপন্থী’ হিসাবে যাঁরা পরিচিত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এই সময়ে হয় ‘মধ্যপন্থী’ হয়েছেন অথবা শিবির বদলের ‘ঝোঁক’ দেখিয়েছেন। অনুব্রত সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে অবহিত নন, এমনটা কেউই মনে করছেন না।

অনুব্রত তিহাড়ে থাকাকালীন কিছু ‘সমীকরণ’ বদলেছে জেলায়। বীরভূমের রাজনীতিতে বরাবর ‘অনুব্রত-বিরোধী’ হিসাবে পরিচিত কাজল শেখ এখন জেলা পরিষদের সভাধিপতি। নানুরের নেতা কাজল জেলার কোর কমিটিরও সদস্য। পাশাপাশিই, দিল্লি গিয়ে যে নেতা অনুব্রতের সবচেয়ে বেশি খোঁজখবর রাখতেন, তিনিও নানুরের। এই বিষয়টি ‘উল্লেখযোগ্য’ বলে মনে করছেন শাসকদলের অনেকে।

অনুব্রত ফেরার পরের ঘটনাপ্রবাহে নজর রেখেছিলেন কলকাতার তৃণমূল নেতারাও। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘সারা দিন চলে গেল। কিন্তু রানাকে কেষ্টদার বাড়ির আশপাশে দেখা গেল না! এটাও কেমন কেমন লাগছে।’’ রানা অর্থাৎ লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ কেষ্টর ‘ডানহাত’ বলেই পরিচিত ছিলেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকেও ছিলেন। কিন্তু বোলপুরের নিচুপট্টিতে অনুব্রতের বাড়িতে যাননি।

মমতা বোলপুরে থাকায় তাঁর সঙ্গে অনুব্রতের সাক্ষাৎ নিয়ে একটা জল্পনা হয়েছিল। অনুব্রতও বাড়িতে ঢোকার আগে বলেছিলেন, ‘‘আমি দিদিকে ভালবাসি। দিদিও আমায় ভালবাসেন। শরীর ঠিক থাকলে দিদির সঙ্গে দেখা হবে।’’ কিন্তু তা হয়নি। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের বক্তব্য, ‘‘দিদির সঙ্গে কেষ্টদার কেন দেখা হল না, এ নিয়ে জল্পনা অর্থহীন। দেখা না-হওয়াটাই স্বাভাবিক। মুখ্যমন্ত্রী সদ্য জামিন পাওয়া কেষ্টদার সঙ্গে দেখা করলে আরও বেশি করে তাঁর ঘাড়ে প্রভাবশালী তত্ত্ব চেপে বসত।’’

মঙ্গলবার কাকভোরে অনুব্রত যখন কলকাতা বিমানবন্দরের লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন তিনি হুইলচেয়ারে। সেখান থেকে নেমে উঠেছিলেন গাড়িতে। সেই গাড়ি সকাল ৯টা নাগাদ বোলপুরে নিচুপট্টিতে তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হেঁটেই গাড়ি থেকে নামেন তিনি। বাড়ির সামনের রাস্তায় তখন গিজগিজ করছে মানুষ। উড়ছে সবুজ আবির। স্লোগান উঠছে, ‘অনুব্রত মণ্ডল জিন্দাবাদ’। বহু দিন পরে যে স্লোগান শুনেছেন অনুব্রত। গাড়িতে বসে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অঝোরে কাঁদতেও দেখা গেল তাঁকে। গাড়ি থেকে নেমে সমবেত জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অনুব্রত ঢুকে যান বাড়িতে।

২৫ মাস ১৩ দিন কেটে গিয়েছে। বাড়ি ফিরেছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ অনুব্রত ‘কেষ্ট’ মণ্ডল। কিন্তু প্রথম দিনেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, অনুব্রত আছেন ‘গোষ্ঠী-ব্রতে’ই। আছে তৃণমূলও।

আরও পড়ুন
Advertisement