AICC

বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়া’ জোটে মমতা-সনিয়া-রাহুলের সুসম্পর্কের অভিঘাতে কি সরতে হবে অধীরকে?

বেঙ্গালুরুতে বিজেপি বিরোধী জোটের বৈঠকের পর এআইসিসি নেতৃত্ব বেশ কয়েকটি রাজ্যের সভাপতি বদল করতে পারেন বলে একটি সূত্রের দাবি। সূত্রের আরও বক্তব্য, তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ এবং তামিলনাড়ু।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৩ ২০:৫৮
pictuer of Adhir Chowdhury

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। ফাইল চিত্র।

বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোটের বৈঠকের পরেই দেশের রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে বিভিন্ন নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে জল্পনা। সেই অধ্যায়েই কিছু রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বদলের জল্পনাও শুরু হয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু-সহ আরও কয়েকটি রাজ্য।

অতি সম্প্রতি আসন্ন বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে ছত্তীসগঢ় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বদল করেছে কংগ্রেস। মোহন মরকমকে সরিয়ে সভাপতি করা হয়েছে সাংসদ দীপক বাজিকে। আবার মহারাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের পর লোকসভা ভোটের সমীকরণ মাথায় রেখেই বদল করা হয়েছে মুম্বই কংগ্রেসের সভাপতিও। ভাই জগতাপকে সরিয়ে সভাপতি করা হয়েছে বর্ষা গায়কোয়াড়কে।

Advertisement

এআইসিসি নেতৃত্বের একাংশের অভিমত, লোকসভা ভোটের প্রয়োজনে আরও কয়েকটি রাজ্যে সভাপতি বদল জরুরি। বিভিন্ন রাজ্যে জোট সমীকরণের কথা মাথায় রেখেই হতে পারে সেই বদল। ২৪ আকবর রোডের একটি সূত্রের দাবি, পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিও বদল করা হতে পারে লোকসভা ভোটের আগে। অধীর চৌধুরীর বদলে দায়িত্বে আসতে পারেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। তবে এই সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত নয়। সবটাই রয়েছে জল্পনার স্তরে।

বুধবার এই বিষয়ে প্রদীপকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘দল এখনও এ বিষয়ে আমাকে কিছু জানায়নি। তবে আমরা জানি, বেঙ্গালুরুর বৈঠকের পর কর্মীদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কারণ, তাঁরাই তো স্বল্প সামর্থ্য নিয়ে লড়াই করে মার খেয়েও কংগ্রেসের পতাকা তুলে ধরে রেখেছেন।’’ তবে পাশাপাশিই প্রদীপের সতর্ক সংযোজন, ‘‘সকলের আগে মাথায় রাখতে হবে, এটা লোকসভা নির্বাচন। বিধানসভা বা স্থানীয় কোনও নির্বাচন নয়। এখানে আমাদের লড়াই বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে। তাদের হারাতেই হবে!’’

প্রসঙ্গত, প্রদীপ এর আগেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। হয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেসের যৌথ কার্যনির্বাহী সভাপতিও। কিন্তু সেই অতীত অভিজ্ঞতা নয়। বিজেপির বিরোধী জোটের এই আবহে প্রদীপের ‘পক্ষে’ যেতে পারে তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সমীকরণ। অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রদীপ রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন মমতা তথা তৃণমূলের সমাবেশে। যে মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৮ অগস্ট। কংগ্রেসের নেতা হওয়ায় প্রদীপ বিভিন্ন সময়ে তৃণমূলের সমালোচনা করেছেন বটে। কিন্তু অধীরের মতো তৃণমূল সম্পর্কে তাঁর অবস্থান অতটা ‘কঠোর’ নয় বলেই মনে করা হয়। অনেকেরই বক্তব্য, তৃণমূলের ‘সৌজন্যে’ রাজ্যসভার সাংসদ হওয়ায় প্রদীপ রাজ্যের শাসকদল সম্পর্কে খুব ‘কড়া’ হতে পারে না। যদিও প্রদীপ নিজে সেই তত্ত্ব সবসময়েই উড়িয়ে দেন।

বস্তুত, বাংলায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের পথে যদি কেউ ‘কাঁটা’ হতে পারেন, তিনি অধীর। যিনি আগাগোড়াই মমতা তথা রাজ্য সরকারকে কড়া আক্রমণ করে এসেছেন। সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটের আগে-পরেও অধীর কঠোরতম ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে আক্রমণ করেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে রাতভর অবস্থানে বসেছেন বিডিওর দফতরের সামনে। মমতা নিজে তো বটেই, তৃমমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও অধীর সম্পর্কে স্বভাবতই বিরূপ। যে কারণে আগামী লোকসভা ভোটে অধীরের বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রটিতে তৃণমূল ‘বিশেষ নজর’ দিচ্ছে।

সনিয়া-রাহুল বিলক্ষণ জানেন, মমতার সঙ্গে জোটে অধীর ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। প্রদেশ সভাপতি হিসেবে প্রস্তাবিত জোট নিয়ে তাঁর মন্তব্য, বক্তব্য এবং অভিমত ঐক্যের পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে। সেই কারণেই অধীরের বদলে তুলনায় ‘নরমপন্থী’ প্রদীপের নাম নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কী ভাবে অধীরকে সরানো হবে, জল্পনা এবং আলোচনা শুরু হয়েছে তা নিয়েও। একটি সূত্র জানাচ্ছে, অধীরের কাজের ভার ‘লাঘব’ করার কথা বলা হতে পারে। অধীর বর্তমানে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা। সঙ্গে সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানও বটে। তাই তাঁর কাজের ‘ভার’ লাঘব করে প্রদেশ সভাপতি করা হতে পারে প্রদীপকে। আর রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে যেহেতু প্রদীপের মেয়াদ অগস্টের মাঝামাঝি শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই রাজ্যে সময় দেওয়া নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা থাকবে না।

অনেকে অবশ্য মনে করছেন, যদি সত্যিই শেষপর্যন্ত অধীরকে সরিয়ে প্রদীপকে প্রদেশ সভাপতি করে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড, তা হলে তারা আগে থেকেই আসন সমঝোতা নিয়ে ‘দর কষাকষি’ করার ক্ষেত্রে খানিকটা পিছিয়ে থেকেই শুরু করবে। আবার অন্য একাংশের মতে, অধীরকে সরালে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ স্তর থেকে মমতাকে এই ইতিবাচক বার্তাও দেওয়া যাবে যে, কংগ্রেস যথেষ্ট ‘নমনীয়তা’ দেখাচ্ছে। বস্তুত, অনেকে মনে করছেন, অধীরকে প্রদেশ সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে আসলে তাঁর বহরমপুর আসনটি ‘রক্ষা’ করতে চান কংগ্রেস নেতৃত্ব। কারণ, রাজ্যে কংগ্রেসের যে দু’টি লোকসভা আসন রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল বহরমপুর। অন্যটি মালদহ দক্ষিণ। সেখানে জিতেছিলেন গনি খানের ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরী। আসন নিয়ে দর কষাকষি শুরু হলে ওই আসন দু’টি চাইবেই কংগ্রেস। কিন্তু রাজ্যে তাদের ‘প্রভাব’ অনুযায়ী তৃণমূল ৪২টি আসনই চেয়ে বসতে পারে! তার ইঙ্গিত মমতা আগেও দিয়ে রেখেছেন। যখন তিনি বলেছিলেন, একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিতে হবে। কিন্তু সেই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে হবে যে দল যে রাজ্যে শক্তিশালী, তার ভিত্তিতে। সাগরদিঘির বাইরন বিশ্বাস তৃণমূলে চলে আসার পর কংগ্রেসের রাজ্যে একটিও বিধায়ক নেই। শিবরাত্রির সলতের মতো পড়ে আছে দু’টি লোকসভা আসন।

ইতিহাস বলছে, বাংলায় কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক ভেঙেই সফল হয়েছে তৃণমূল। বিক্ষুব্ধ মমতা কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল গঠনের সময় কংগ্রেসের সিংহভাগ ভোট নিজের দিকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ, তৃণমূল এবং কংগ্রেস— উভয় পক্ষই জানে, একের ব্যর্থতায় অন্যের সাফল্য। সেই কারণেই মমতা চাইবেন, কংগ্রেসের আসন কমুক। অর্থাৎ, অধীরকে আসন না-দেওয়া হোক।

বেঙ্গালুরুতে যে ভাবে মমতা রাহুলকে ‘আওয়ার ফেভারিট রাহুল’ বলে সম্বোধন করেছেন, তা অনেককেই চমকিত করেছে। আর সনিয়ার সঙ্গে মমতার সম্পর্ক ব্যক্তিগত এবং গভীর। অনেকে বলছেন, সনিয়ার সঙ্গে মমতা অনেক বেশি ‘স্বচ্ছন্দ’ও বটে। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে আসন নিয়ে দর কষাকষির সময় সনিয়ার সক্রিয় হস্তক্ষেপেই মমতার কংগ্রেসকে ১৪টি বেশি আসন দিতে হয়নি।

এখন দেখার, বিজেপিকে হটানোর স্বার্থে শেষপর্যন্ত সনিয়া-রাহুল অধীরকে প্রদেশ সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে মমতাকে বার্তা দেন কি না। তারই পাশাপাশি অধীরের বহরমপুর আসনটি নিজেদের জন্য রেখে দিতে পারেন কি না।

Advertisement
আরও পড়ুন