Padma Shri

পদ্ম সম্মান শুধু পদ্মবনেই! রাজনীতির ‘ঝোঁক’ বিচারে সম্মান বাছাই, বাংলা দখলে কি আদৌ আগ্রহী বিজেপি?

পদ্ম সম্মানকে যদি রাজনীতির হাতিয়ারই করতে হয়, তা হলে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হবে না কেন? এমনই প্রশ্ন ঘিরে এখন শুরু হয়েছে চর্চা। সে চর্চা চলছে বিজেপির ভিতরেও।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:০২
Padma Awards only for the inmates of Lotus Lake? Did BJP just miss the bus for 2026 polls in WB

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

পেনাল্টি মিস্‌! আরও একবার বিজেপি প্রমাণ করল, বঙ্গ রাজনীতির ময়দানে বারপোস্টের ঠিকানা তারা এখনও ভাল চিনে উঠতে পারেনি। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে নিজেদের গা থেকে ‘বাংলা বিরোধী’ তকমা মোছার ‘হাতিয়ার’ হতে পারত পদ্ম সম্মান। বাংলার শিল্প এবং সংস্কৃতির মহলে নিজেদের ‘বৃত্ত’ খানিকটা বাড়িয়েই নিতে পারত বিজেপি। কিন্তু পদ্মবনের বাইরে বেরনোর চেষ্টা দেখা গেল না। যা এই আলোচনার জন্ম দিয়েছে যে, বিজেপি কি আদৌ বাংলা দখলে আগ্রহী?

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গ থেকে এ বছর পদ্মশ্রী পেয়েছেন ন’জন। প্রাপকদের ‘কৃতিত্ব’ নিয়ে প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই সংশয় নেই। যেমন তালিকায় রাজনীতির ‘ছাপ’ যে রয়েছে, তা নিয়েও খুব দ্বিমত নেই। সেই সূত্রেই বিজেপির ভিতরেও আলোচনা শুরু হয়েছে এই মর্মে যে, পদ্ম সম্মানকে যদি রাজনীতির ‘হাতিয়ার’ করতেই হয়, তা হলে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নয় কেন?

সরকারি পুরস্কার অনেক ক্ষেত্রেই ‘কর্তাভজা’-দের উপর বর্ষিত হয়। এ বহুকালের রেওয়াজ। তা নিয়ে যে বিতর্ক হয় না, তা-ও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রেওয়াজ চলতেই থাকে। এ বারের পদ্ম সম্মানও তার ব্যতিক্রম হতে পারেনি। কিন্তু বিজেপি সেই রেওয়াজের বাইরে গিয়ে বাংলা এবং বাঙালিদের ক্ষেত্রে ‘ব্যতিক্রমী’ হতে পারত।

যে দিন পদ্ম পুরস্কার ঘোষিত হল, ঘটনাচক্রে সে দিন সন্ধ্যায় বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ তথা রাজ্য দলের প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য এক বামপন্থী নাট্যকারের প্রশংসা করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আরএসএস-ঘনিষ্ঠ অধ্যাপকের লেখা বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে গিয়ে নাট্যকার চন্দন সেনের একটি নাটকের প্রশংসা করে শমীক বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের জীবন কতটা কষ্টের, তা নিয়ে চন্দন সেনের একটি নাটক আছে ‘বিয়ে গাউনি কাঁদন চাঁপা’। চন্দনবাবু রাজনৈতিক ভাবে আমাদের বিপরীতে। কিন্তু তিনিও নিজের নাটকে দেখিয়েছেন, ওই সম্প্রদায়ের মহিলারা কী রকম অত্যাচারিত জীবন কাটান।’’

অর্থাৎ, সরাসরি বিজেপি বা সঙ্ঘের বৃত্তে যাঁরা নেই, তাঁরাও যে নানা ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন, তা শমীকের মতো বিজেপি নেতা মানেন। তা হলে পদ্ম সম্মানের বৃত্তে তাঁদের নিয়ে আসা হয় না কেন? আগামী বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে কি এখন থেকেই বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি জগতে নিজেদের ‘বৃত্ত’ বাড়ানো যেত না? সরাসরি জবাব এড়িয়েছেন শমীক। বলেছেন, ‘‘আমি থিয়েটারপ্রেমী। তাই বাংলা থিয়েটারের জগৎ থেকে কেউ এই সম্মান পেলে আমি আরও আনন্দিত হতাম।’’

বিজেপি সাংসদের এই মন্তব্যে স্পষ্ট, ‘পেনাল্টি মিস্‌’ করার যন্ত্রণা বিজেপির অন্দরেও অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হল? বিজেপি সূত্রের দাবি, এ রাজ্যের পদ্ম সম্মানের তালিকা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয় এক প্রাক্তন সাংসদ কর্তৃক। তাঁর পছন্দের তালিকায় না ঢুকতে পারলে বাংলা থেকে পদ্ম সম্মান পাওয়া কঠিন। বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি সাউথ ব্লকের ‘পছন্দের’। কেউ নর্থ ব্লকের ‘ঘনিষ্ঠ’। আবার কেউ সরাসরি নাগপুরের ‘আস্থাভাজন’। যেমন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী, রাশিদ খান বা এ বারের পদ্মশ্রীপ্রাপক তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। কিন্তু তাঁদের বাইরেও অনেকে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন। তাঁদের সম্মানিত করে কেন কাছে টানা গেল না? তার জবাব নেই।

জবাব অবশ্য আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার শিল্পী-সদস্য বাবুল সুপ্রিয়ের কাছে। প্রাক্তন বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন, ‘‘যাঁরা এ বার পদ্মশ্রী পেয়েছেন, তাঁদের একটুও খাটো না করে বলতে পারি, অনেক সুযোগ্য মানুষ আছেন, যাঁদের পদ্ম পুরস্কার দিলে পুরস্কারের সম্মানই বাড়ত।’’

বাংলা থেকে এ বার যাঁরা পদ্মশ্রী পেয়েছেন, তাঁদের প্রায় সকলের ‘কৃতিত্ব’ই প্রশ্নাতীত। কিন্তু পদ্ম সম্মানের ক্ষেত্রে নিজেদের ‘সীমাবদ্ধ’ বৃত্তের বাইরে কেন বিজেপি সরকার বেরতে পারছে না, সেই প্রশ্নও উঠছে। অরিজিৎ সিংহকে ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাঙালির আবেগ বুঝতে না পারার অভিযোগ উঠছে। মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের সন্তান অরিজিৎ দেশের জনপ্রিয়তম প্লেব্যাক গায়ক। সেই অরিজিৎ পেলেন পদ্মশ্রী! যেখানে উষা উত্থুপের মতো গায়িকা আগেই ‘পদ্মভূষণ’ পেয়ে গিয়েছেন! পদ্ম সম্মানের বৃত্তে ‘প্রভাবশালী’ প্রাক্তন বিজেপি সাংসদের ঘনিষ্ঠের যুক্তি, ‘‘উষা উত্থুপ আগে পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন। তাই পরে পদ্মভূষণ দেওয়া হয়েছে। অরিজিৎ তো এই প্রথম পদ্মসম্মান পেলেন। তাই পদ্মশ্রী। মান্না দে, অজয় চক্রবর্তী, রাশিদ খানও প্রথমে পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন। পরে পদ্মভূষণ পান।’’ তবে তথ্য বলছে, পদ্মশ্রী না পেলেও সরাসরি তার উপরের স্তরের পুরস্কার দেওয়া যায়। অভিনেতা ভিক্টরকেই সরাসরি ‘পদ্মভূষণ’ দেওয়া হয়েছিল। অরিজিৎকেও সরাসরি পদ্মভূষণ দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বাবুল। তাঁর কথায়, ‘‘অরিজিৎ যতটা কম বয়সে যা অর্জন করেছেন, তাতে ওঁকে সরাসরি পদ্মভূষণই দেওয়া উচিত ছিল। কেন পদ্মশ্রী দেওয়া হল বুঝলাম না।’’ পাশাপাশিই তাঁর কটাক্ষ, ‘‘অবশ্য যে দেশে কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, আশা ভোঁসলেরা ভারতরত্ন পান না, সেখানে সব কিছুই হতে পারে।’’

২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে আর মাত্র একবারই পদ্মসম্মান দেওয়ার সুযোগ পাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তা-ও ভোটের মাত্র কয়েক মাস আগে। সে সময়ে যদি পদ্মবনের বাইরের কাউকে বেছে নেওয়াও হয়, তা হলেও কি খুব লাভ হবে? সংশয় এবং আক্ষেপ রয়েছে বিজেপির অন্দরেও। রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সহ-সভাপতি রাজকমল পাঠক বলছেন, ‘‘পদ্ম সম্মানের বৃত্ত বাড়ানোর সুযোগ থাকলে সেটা নেওয়া উচিত ছিল।’’ আক্ষেপের সুরে তিনি বলছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে যাত্রা এখনও একটা খুব জনপ্রিয় শিল্প। যাত্রার কেউ সম্মানিত হলে গ্রামবাংলার মানুষকে অনেক বেশি করে স্পর্শ করা যেত। শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও অনেক বাঙালি এখন সফল। রাজ্যে কনফেকশনারি ইন্ডাস্ট্রিতে এখন বাঙালিদের দাপট। অলঙ্কার ব্যবসাতেও এখন একাধিক বাঙালি উদ্যোগপতির সাফল্য চোখে পড়ার মতো। তাঁদের মধ্যে মহিলারাও রয়েছেন। এঁদের কথা ভাবা গেলে ভাল হত।’’

Advertisement
আরও পড়ুন