Bhai phonta

ভাইফোঁটা: সমানুভূতির মন্ত্র হোক উচ্চারিত

সত্তর আশির দশকের কথা। লম্বা বারান্দায় বড় থেকে ছোট পরিবারের যত ভাইবোন একসঙ্গে বয়স অনুযায়ী পর পর আসন পিঁড়িতে বসে পড়া। কেউ কেউ বড় আলসে, তাদের ঘুম থেকে তোলা ছোট বোনটির দায়িত্ব।

Advertisement
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:৫১
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা।

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা। —প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

কার্তিকের হিমেল হাওয়া আর উষ্ণতা মিলেমিশে দীপাবলির দিনগুলো পেরিয়ে গেলেই এসে পড়ে ‘ভ্রাতৃদ্বিতীয়া’ বা ভাইফোঁটা। কেউ প্রতিপদে, কেউ দ্বিতীয়ায় তিথি পঞ্জিকা মেনে ভাইদের মঙ্গল কামনায় দিদিরা, বোনেরা পালন করেন এই উৎসব বা প্রথা। ভাইদের ও মনের কোণে প্রতীক্ষার দিন গোনা। কোনও কোনও বছরে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বয়ে এনেছে কত না প্রতিশ্রুতি.. যে প্রতিশ্রুতির টানে ছুটে যাওয়া যায় এক শহর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া অন্য শহরে, জন্মভূমির গ্রামে।

Advertisement

সত্তর আশির দশকের কথা। লম্বা বারান্দায় বড় থেকে ছোট পরিবারের যত ভাইবোন একসঙ্গে বয়স অনুযায়ী পর পর আসন পিঁড়িতে বসে পড়া। কেউ কেউ বড় আলসে, তাদের ঘুম থেকে তোলা ছোট বোনটির দায়িত্ব। ভোর হতে না হতেই দূর্বা ঘাসের উপর শিশির কাচিয়ে তুলে নেওয়া, ঠাকুর ঘরের বাটিতে শ্বেত ও রক্তচন্দন বেঁটে তুলে রাখা। ঘি, কাজল, পান পাতা কোনওটাই বাদ পড়েনি। সকালে নতুন শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবি বা শার্টের গন্ধ অথবা ধুয়ে তুলে রাখা পোশাকে কখনও মাটির বারান্দা অথবা শান বাঁধানো বারান্দায় লম্বা হয়ে বসে যাওয়া। দিদি, বোনেরাও বয়স অনুযায়ী যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য মেনে কপালে এঁকে দিয়েছে পর পর তিনটে টিপ, বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে, 'ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা.... 'এটুকু মুখে উচ্চারিত, পরের টুকু ফিস ফিস। ‘আমার ভাইয়ের যেন একশো বছর আয়ু হয়’। তখন সত্যি ভাবিনি কখনও, এই যে দাদাদের আশীর্বাদ, কেউ কেউ লজ্জা লজ্জা মুখে ধান দুর্বা দিয়েছে মাথায়... সেখানেও হয়তো বোনের জন্য মনে মনে প্রার্থনা থাকত।

নারীরা আজ বহু ক্ষেত্রে নিজেই নিজের অধিকার বুঝে নিয়ে একে অন্যের কপালে ‘বোন ফোঁটা’ পরিয়ে দিচ্ছে, তিলক এঁকেছে চন্দনে অথবা পবিত্র দইয়ের টিকা পরিয়েছে। কিন্তু যখনই একই রক্ত, একই অধিকারের প্রশ্ন, ভাইয়েরা বহু ক্ষেত্রে বঞ্চিত করছে সহোদরাকে। যোগ্য সম্মানের ক্ষেত্রকে কলুষিত করেছে। এটাই যেন নিয়ম। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এ সবের ব্যতিক্রমও আছে।

এখনকার ভাবনায় বহু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে আনে। বিশেষ করে নতুন যুগের ভাইয়েরা। এ বছর তারা বোনেদের উদ্দেশে হয়তো ‘অভয়া’ ফোঁটাও দিচ্ছে কোথাও কোথাও। এ সম্মানের আজ বড় প্রয়োজন। অসম্মানিত, চিরকালীন শাশ্বত ধারণা আর যম-যমুনার গল্পে বন্দি না থেকে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষায় এগিয়ে আসছেন ভাইয়েরা। এঁকে দিচ্ছেন কপালে টিপ। এ টুকুই হেমন্তের আলোর শেষ আশা টুকু জাগিয়ে তোলে।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া যেমন ভাইয়ের জন্য অগ্রজের জন্য ঐকান্তিক প্রার্থনার দিন, অন্য দিকে নারীর জন্যও হয়ে উঠুক মঙ্গলময়। ছ’বছরের শিশুকন্যা থেকে বয়সিনী নারী ফিরে পাক হৃত সম্মান। অধিকারের জয়টীকা স্বেচ্ছায় তাকেও পরানো হোক। বাজুক মঙ্গল-শঙ্খ। সহানুভূতি নয়, সমানুভূতির মন্ত্র উচ্চারিত হোক।

(কবি, জলপাইগুড়ি)

আরও পড়ুন
Advertisement