Flash Flood in Sikkim Update

ভয়ের অন্ধকারে ডুবেছে সিকিম, রাত জেগে তিস্তার গর্জন শোনেন ওঁরা! প্রশ্ন, আবার ফুঁসে উঠবে না তো

মঙ্গলবার রাত থেকে সিকিমের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। গ্যাংটকের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবারহ সচল থাকলেও গোটা রাজ্যের অনেক গ্রাম এবং ছোট শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।

Advertisement
পার্থপ্রতিম দাস
সিকিম শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩ ১০:৩২
Many people living in fear after evening in North Sikkim as electricity is disconnected

তিস্তার তাণ্ডবে বিপর্যস্ত সিকিম। ছবি: পিটিআই ।

চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারই মধ্যে পাহাড়ের কোলে একটা-দুটো আলো টিমটিম করে জ্বলছে। আর সে দিকে তাকিয়েই মনে ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে রাত্রিযাপন করছেন বানভাসি উত্তর সিকিমের বহু মানুষ। ভোর হওয়ার অপেক্ষা এবং আতঙ্ক নিয়ে রাত কাটাচ্ছেন তাঁরা। মনে তাঁদের একটাই প্রশ্ন, ‘‘তিস্তা আবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে না তো? অন্ধকারে ভেসে যেতে হবে না তো?’’

Advertisement

হু হু করে বাড়ছে সিকিমের দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা। সিকিমের লোনক হ্রদ ফেটে সৃষ্টি হওয়া বন্যা কমপক্ষে ২৪ হাজার মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। মৃত্যুর সংখ্যা ২৫ ছাড়িয়েছে। তিস্তার তাণ্ডবে সড়কপথ থেকে টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা— সব কিছুই বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। যার ফলে সন্ধ্যা থেকেই অন্ধকার নামতে শুরু করেছে গোটা পাহাড়ি এলাকা জুড়ে।

মঙ্গলবার রাত থেকে সিকিমের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। গ্যাংটকের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবারহ সচল থাকলেও গোটা রাজ্যের অনেক গ্রাম এবং ছোট শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। যে বাড়িগুলিতে ইনভার্টার রয়েছে, সেগুলিরও শক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার পথে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি ভেসে গিয়েছে সিকিমের বহু মানুষের। বহু জায়গায় উদ্ধারকাজ শুরু করা সম্ভব না হওয়ায় অনেকের কাছে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নেই। কোনও রকমে উঁচু জায়গা দেখে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মীদের সঙ্গে সেখানেই রাত কাটাচ্ছেন তাঁরা। সন্ধে নামলেই অন্ধকারের সঙ্গে ভয় নেমে আসছে তাঁদের মনে। দিনের বেলা যেমন তেমন করে কাটলেও সন্ধ্যার পর শুরু হয় আতঙ্কের পরিবেশ।

সিংথামের বাসিন্দা তংডুং শেরপা বলেন, ‘‘তিস্তাকে কেন্দ্র করে একের পর এক জলাধার এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হয়েছে। সে অর্থে আমাদের বিদ্যুতের সঙ্কট ছিল না। কিন্তু সিকিমের বিপর্যয়ের পর বিদ্যুৎ সরবারহ সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ। অন্ধকারকে আমরা কখনওই ভয় করি না। আমরা শেরপা। অসাধ্যকে সাধন করতে পারি। কিন্তু পরিবার? সেই পরিবারই দুর্বলতা। স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে নিয়ে কী ভাবে রাতের পর রাত কাটছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।’’

সন্ধ্যা নামলে পাহাড়ের চারদিকে ঘন কালো অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার পর কী ভাবে আতঙ্ক তাঁদের গ্রাস করে, তা-ও জানিয়েছেন তংডুং। বলেন, ‘‘সন্ধ্যার পর সকলের দুশ্চিন্তা শুরু হয়। কান পেতে রাখি। তিস্তার শব্দ শুনি। আমার জন্মের পর তিস্তার এমন ভয়াবহ রূপ দেখিনি। এই গর্জনও শুনিনি। পাহাড়ের মাঝে সেই শব্দ আরও ভয়ানক শোনাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি রাতই জেগে কাটাচ্ছি। ল্যাম্প বা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখছি রাতভর। আবার দুর্যোগ এলে অন্তত যাতে প্রাণে বাঁচতে পারি, সেই কারণে পরিবারের সকলে পালা করে জেগে থাকছে।’’

চাকরি সূত্রে সিকিমের রংপোয় বসবাস করেন পশ্চিমবঙ্গের ছেলে শুভম সরকার। তিস্তার তাণ্ডব ভয় ধরিয়েছে তাঁর মনে। আঁধার নামলেই আতঙ্ক গ্রাস করছে শুভম এবং তাঁর সহকর্মীদেরও। শুভমের কথায়, ‘‘আশপাশের তিন-চার তলা বাড়িগুলির অর্ধেক মাটির নীচে। আমরা যেই আবাসনে থাকি সেটা তিন তলা৷ একতলায় পলি জমে রয়েছে। বিদ্যুৎ নেই। হাতেগোনা যে কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ রয়েছে, দিনের বেলা সেখানেই মোবাইল চার্জ দিতে যাই। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে ওরা চিন্তায় থাকে। আমরা যারা একসঙ্গে রয়েছি, তারা দিনের দিকটাতেই বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছি৷ সন্ধে হলেই তো চারিদিক অন্ধকার, শুনশান। এতটাই চুপচাপ হয়ে যায় যে, তিস্তার ভেসে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পাই। দুর্যোগের পর থেকেই কান খাড়া করে আছি। বিগত দু’দিন ধরে আমরা এক জায়গায় বসে রাত কাটাচ্ছি।’’

সিকিমের নামচি জেলার খয়েরবাড়ির বাসিন্দা ডোলমা শুব্বার বক্তব্য, ‘‘চোখের সামনে পাহাড় ধসে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য আমার বাবারাও দেখেনি। ’৬৮ সালের বন্যাতেও এত ক্ষতি হয়নি আমাদের। নদীর পারে বাস। চারদিক পাহাড়ে ঘেরা। প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করার পর থেকে আমাদের গ্রাম-সহ আরও পাঁচটি গ্রামের মানুষ একসঙ্গে আছি। ঘরবাড়ি, গবাদি পশু— সব ভেসে গিয়েছে। গ্রামের বহু মানুষ নিখোঁজ। দিনের বেলা তাঁদের খোঁজার চেষ্টা করি। মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজার চেষ্টা করি। রাতে সকলে সজাগ থাকি। তিন দিন হল বিদ্যুৎ নেই। কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগও নেই। প্রশাসন আমাদের কথা কতটা জানে, সেটাও জানি না। মাঝেমধ্যে তাদের প্রতিনিধিদের দেখি। রাতের অন্ধকারের থেকে ভয়ের অন্ধকারে ডুবে মরছি আমরা।’’

আরও পড়ুন
Advertisement