সাধন মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।
এলাকায় রেলপথ নেই। কিন্তু রেল কাকু রয়েছেন।
জায়গার নাম করিমপুর আর ‘রেলকাকু’ হলেন সাধন মণ্ডল। বছর আটষট্টির এই প্রবীণকে এলাকার মানুষ এই নামেই চেনেন। কারণ, এক সময়ে লোকের চিকিৎসার প্রয়োজনে নিয়মিত রেল পথে যাতায়াত করার সুবাদে কোথায় গেলে, কোন সময়ে কোন ট্রেন মিলবে, তার পরামর্শ এক লহমায় দিতে পারেন তিনি। গোটা দেশের রেলপথ যোগাযোগের ছক তাঁর মাথায় ছবির মতো গাঁথা। সাধনবাবুর দক্ষতা শুধুমাত্র জেলার ট্রেনের টাইম টেবল মনে রাখাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে তিনি গোটা ভ্রমণ পথও ছকে দিতেও পারেন দুর্দান্ত। তাই এলাকার মানুষের কাছে তিনি সাধন নামের চেয়ে অনেক বেশি পরিচিত ‘রেলকাকু’ নামে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে জানা গেল, ভারতের বিশেষ বিশেষ শহরের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি ট্রেনের নম্বর থেকে কোন ট্রেন কোন স্টেশনে কখন দাঁড়ায়, কোন ট্রেনে গেলে নির্দিষ্ট দিনেই পৌঁছে ডাক্তার দেখানো যাবে, কোন ট্রেনের খাবার ভাল ইত্যাদির নানা সন্ধান তাঁর কাছে হাজির। কেউ যে কোনও রেল সংক্রান্ত যে কোনও অনুসন্ধানে তাঁকে একবার ফোন করে নিলেই হল। গড়গড় করে বলে যাবেন যাবতীয় জরুরি তথ্য।
এমন অসামান্য স্মৃতিশক্তি যাঁর, তাঁর কর্মস্থলে এই প্রতিভা কতটা কাজে লাগে?
সাধনবাবু জানালেন, এক কালে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করেও সফল হননি। অবশেষে টিভি-রেডিয়ো মেরামতির কাজ বেছে নেন। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৮ সালে প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক আমায় অনুরোধ করেন, তাঁর বাবার চিকিৎসার জন্য বাইরের কোনও ভাল হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা তথা পরিকল্পনা করে দিতে। সঙ্গে আমাকেও যেতে বলেন। সেই থেকে আমার রেল যাত্রা শুরু হয়।’’
করিমপুরের নাটনা গ্রামের বাসিন্দা তিনি। রমরমা ইন্টারনেটের যুগেও এলাকার মানুষকে এখনও সমান্তরাল পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি, এমনটাই দাবি তাঁর। সাধনবাবু বলেন, ‘‘ঘটনাক্রমে ওই ভদ্রলোক রোগ-মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। এর পর থেকে কারও কোনও কিছু হলেই আমায় তাদের সঙ্গে যেতে হত। এই করতে করতে ভেল্লোর, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো নানা জায়গার হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে যেতে শুরু করি।’’
তিনি জানালেন, এর পর ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য রেলপথের মাধ্যমে রোগীদের নিয়ে যেতে গিয়ে নিজেই বাড়িতে থাকতে পারতেন না। তা নিয়ে পরিবারে বহু অশান্তিও হয়েছে।
তাঁর নিজের এলাকায় রেলপথের দাবি বহু দিনের। স্থানীয়দের যাতায়াতের ক্ষেত্রেও সমস্যার মুশকিল আসান ‘রেল কাকু’। কোন স্টেশন থেকে নেমে কোথায় যাওয়ার ট্রেন সহজে মিলবে, তা-ও ছকে দেন। কোন স্টেশনের কোথাকার খাবার ভাল, সেটাও ফুটনোটে থাকে। ফলে, চূড়ান্ত ইন্টারনেট-নির্ভর সময়েও গুগ্ল-বাবাজির সাধ্য কী, রেল কাকুকে টেক্কা দেয়! সাধনবাবু বলেন, ‘‘আমাদের এলাকায় রেলপথ নেই। যে কারণে ছোট থেকেই রেলগাড়ি নিয়ে আমার কৌতূহল চরমে ছিল। ওই আগ্রহ থেকেই যাতায়াতের সময়ে রেলগাড়ির নানান বিষয় মুখস্থ করে ফেলি।’’
নাটনা গ্রামের বাসিন্দা দিবাকর সিংহ বলেন, ‘‘রেলে যাতায়াত করতে করতে উনি এতটাই সড়গড় হয়ে গিয়েছেন যে, যে কোনও সময়ে জিগ্যেস করলেই ঠিক তথ্য
দিয়ে দেন।’’