ধুলিয়ানে পাওয়ার হাউসের সামনে ভাঙন। ছবি: জীবন সরকার
ঘরের পাশ দিয়ে বইছে উত্তাল গঙ্গা। তার ভাঙনে ধসে পড়ছে একের পর এক বাড়ি। গত বর্ষার ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই আরও এক বর্ষা পার। ফের ভাঙনের মুখে একাধিক গ্রাম। অথচ অভিযোগ, দু’বছরেও ভাঙন রোধে কোনও স্থায়ী সমাধান বেরোয়নি। কথা রাখেনি কেউ-ই।
রাজ্য সেচ দফতর ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, এই ভাঙন ঠেকানোর ক্ষমতা তাদের নেই। কেন্দ্রের জলসম্পদ মন্ত্রীকে ফোন করে জেলার এক সাংসদ কেন্দ্রীয় সহায়তা চেয়েছেন শমসেরগঞ্জে ভয়াবহ ভাঙন রুখতে। সাংসদের দাবি, কোনও সাড়া মেলেনি। গত দু’বছর ধরে ভাঙন চলছে শমসেরগঞ্জের ধানঘড়া, দুর্গাপুর, কামালপুর, লোহরপুর, শিবপুর, ধুসরিপাড়া, হিরানন্দপুরে। এ বছর সেই মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে চাচণ্ড, জালাদিপুর। গত এক সপ্তাহ ধরে ভাঙন চলছে ধুলিয়ানেও। পুর এলাকার ১৭, ১৮, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১০টি বাড়ি তিনদিনে ধসে গিয়েছে। নদী সংলগ্ন প্রায় ৩০০টি পরিবার অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
গত দু’বছরে শমসেরগঞ্জে সব মিলিয়ে ভাঙনে নদী গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে প্রায় ১২০০ একর জমি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৮০০ পরিবার। গত বছর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৫৭০ পরিবারের একজনও এখনও পুনর্বাসন পাননি বলে অভিযোগ। ২.৭৮ একরের জমির পাট্টা হাতে পেলেও জমির দখল পায়নি ১৯৭টি পরিবারের কেউই। ভাঙনে গৃহহারারা দীর্ঘদিন ধরে কেউ রয়েছেন তাঁবুতে, কেউ বা কারও বাড়ির বারান্দায় মাথা গুঁজে রয়েছেন। কেউ ভিটে হারিয়ে এখনও বাস করছেন সরকারি স্কুলে।
গত এক বছরে ভাঙন-বিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে নেতা-মন্ত্রীদের আনাগোনাও কম হয়নি বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। গ্রামবাসীদের ক্ষোভ, ভোটের সময় শাসকদলের ছোট, মাঝারি মাপের নেতারা আশ্বাসের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। তবে ভাঙন রোধে স্থায়ী বন্দোবস্ত কিছুই হয়নি। ভাঙন রোধে ২৭ কোটি টাকা খরচ করা হবে বলে সেই সময় জল্পনাও রটেছিল। তা শুনে ভাঙন দুর্গতরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ভেবেছিলেন, এ বার হয় তো নদীর পাড় পাকাপাকি ভাবে বাঁধা হবে। থামবে ভাঙন। কিন্তু কোথায়, কী! ওই টাকা এখনও অনুমোদিত হয়নি বলে জানিয়েছে সেচ দফতর। নিমতিতা গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের প্রধান সিউটি হালদার বলেন, “নদীর গতিপ্রকৃতি বোঝা দায়। নদীর জল বাড়লেও ভাঙন হচ্ছে, কমলেও হচ্ছে। গঙ্গার মাঝে গজিয়ে ওঠা চর ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। তার জেরে নদী ধাক্কা মারছে ডান পাড়ে।’’
লোহরপুরের বাসিন্দা ভবেশ মণ্ডল ক্ষোভের সুরে বলেন, “ভাঙন এখন দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে গিয়েছে। লোকজন আসছেন, দেখছেন, চলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের দুর্দশা ঘুচছে না। কেউ আমাদের জিজ্ঞাসাও করে না, কেমন আছি। আমাদের কষ্টের কথা কেউ শোনে না। বর্ষায় নদী পাড়ে ত্রিপলের নীচে বাস করার যন্ত্রণা কেউ বোঝে! সকলে আসছেন রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে।’’ বিকাশ মণ্ডল নামে এক গ্রামবাসী জানান, বাবা-দাদুর মুখে তিনি শুনেছেন এই নিয়ে ছ’বার ভাঙনের মুখে পড়ল তাঁদের পরিবার। ধুসরিপাড়ায় তাঁদের বাড়ি ছিল। বিকাশ বলেন, “গঙ্গার এত ভয়ঙ্কর রূপ আগে দেখিনি। ক’দিন আগেও নির্জলা চর দিয়ে ও পাড়ে গেছি। এখন সেই গঙ্গাই গিলতে আসছে সকলকে। গত বছর চোখের নিমেষে আটটি বাড়ি ধসে পড়ল নদীতে। ভাবিনি, এ ভাবে একদিন রাস্তায় রাত কাটাতে হবে।’’
সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়াররাও ভয়ঙ্কর ভাঙনের কাছে যেন অসহায়। সেচ দফতরের রঘুনাথগঞ্জের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার কল্পরূপ পাল বলছেন, “এই সময় ভাঙন ঠেকানোর সাধ্য আমাদের নেই। কামালপুর থেকে ২ কিলোমিটারের জন্য ২৭ কোটি টাকার প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। একটি বিশেষ তহবিল থেকে টাকা যদি পাওয়া যায় এই আশায়। এখনও তার অনুমোদন মেলেনি। ধুলিয়ান শহরের ৯৫০ মিটার এলাকার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে ১০ কোটি টাকার। সেই টাকা কোন তহবিল থেকে পাওয়া যাবে, তা এখনও বিবেচনাধীন।” পরিস্থিতি যা তাতে আরও ক’দিন যে এই ভাঙনের মোকাবিলা করতে হবে গ্রামবাসীদের, তা এখনই বলা যায়!