Independence day

স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, ঐক্যের মূর্ত প্রতীক

মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে তিনি স্বাধীনতার বাণী প্রচার করতেন। ১৯২৫ সালে তাঁর সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘সৌরভ’ প্রকাশিত হল।

Advertisement
আবুল হাসনাত, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
মুর্শিদাবাদ শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৩ ১০:৫২
স্বাধীনতা দিবসের আগে বিকোচ্ছে পতাকা। বহরমপুরে তোলা ছবি।

স্বাধীনতা দিবসের আগে বিকোচ্ছে পতাকা। বহরমপুরে তোলা ছবি। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাবনায় পরম শ্রদ্ধেয় জননায়ক, মানবতাবাদী, শিক্ষাদার্শনিক এবং সমন্বয়ের আচার্য রেজাউল করিমের অবদান সম্পর্কে স্বল্পপরিসরে এই আখ্যান। বীরভূমের মাড়গ্রামে তাঁর পৈত্রিক নিবাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাবনা ছিল অহেতুসম্ভব। বড় দাদা মইনুদ্দিন হোসাইন প্রতিষ্ঠিত কলকাতার নূর লাইব্রেরিতে (১৯১০ সালে) ছিল সংস্কৃতি ও রাজনীতির হাত ধরাধরি করে পথ চলা। মইনুদ্দিন ছোট ভাইকে কলকাতার বাসায় নিয়ে এলেন। সেখান থেকেই তিনি ১৯১৯ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। রেজাউল করিম পড়াশোনা ছাড়াও আর যা অর্জন করলেন, সে তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞান আর নিষ্কাম জ্ঞানচর্চা। গাঁধীবাদী মইনুদ্দিনের সাহচর্যে রেজাউল করিমও গাঁধী-পথেই সারা জীবনের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র লাভ করেছিলেন। শুধু অন্তরের আকর্ষণে নয়, বহিরঙ্গের আবরণেও।

Advertisement

অবশেষে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পথে নামলেন রেজাউল করিম। আইএ পরীক্ষায় না বসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও গাঁধীর বক্তৃতায় মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ রেজাউল করিম সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ জেলার সালারে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ শুরু করলেন। পাঠ্য বিষয়ে ক্লাস নেওয়া ছাড়াও তিনি রাজনৈতিক ক্লাস নিতেন এবং সে বিষয়ে নোট দিতেন। পরে গাঁধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে জাতীয় বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। রেজাউল করিম দেশের বাড়ি মাড়গ্রামে ফিরে গিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিদ্যালয় শুরু করলেন। সেখানেও তিনি ক্লাস নিতেন। সে সবও ছিল নৈতিক আদর্শ এবং রাজনৈতিক দর্শনে সমৃদ্ধ। এর পরে তাঁর মামা—প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা আব্দুস সামাদের নির্দেশে তিনি বহরমপুর এলেন।

মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে তিনি স্বাধীনতার বাণী প্রচার করতেন। ১৯২৫ সালে তাঁর সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘সৌরভ’ প্রকাশিত হল। সেখানে সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ আলোচিত হত। তার পরে ১৯২৬ সালে আইএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ‘সৌরভ’ বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৩০ সালে বিএ পাশ করে কলকাতায় চলে গেলেন। শুরু হল বিস্তৃত পড়াশোনা ও সাংবাদিকতা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় জাতীয়তা ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভাবনার প্রসারে উজ্জীবক প্রবন্ধ রচনা করে চললেন। প্রকাশিত হল ‘ফরাসি বিপ্লব’, ‘নয়া ভারতের ভিত্তি’, ‘জাতীয়তার পথে’, ‘ফর ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইসলাম’-সহ আরও অন্য বই।

১৯৩৪ সালে এমএ পাশ করার কয়েক বছর পরে ১৯৩৮ সালে তাঁর সম্পাদনায় দৈনিক ‘দূরবীন’ প্রকাশিত হল। ম্যানেজার ছিলেন দাদা মইনুদ্দিন হোসাইন। সেখানেও জাতীয়তা ও স্বাধীনতার বাণী প্রচারিত হত। এর অনেক পরে ১৯৪৫ সালে তিনি যখন নবযুগ কাগজে সহ সম্পাদনার দায়িত্বভার নিলেন তখনও স্বাধীনতা, জাতীয়তার পক্ষে এবং লিগ মানসিকতার প্রতি মহৎ ক্রোধের উচ্চারণে নির্ভীক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সেই বীরত্বের দিনগুলিতে পথ ছিল কণ্টকে আকীর্ণ, লেখনীতে অগ্নির প্রস্রবণ। ফলে ব্যক্তিগত ভাবে নিগৃহীত হলেন ১৯৪৬-এ।

এক ‘রক্ত নিশিভোরে’ যখন বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছল (১৯৪৭), তখন তিনি ভগ্নপদ। আজ মনে পড়ছে মৃত্যুর ঠিক পূর্বে প্রকাশিত রেজাউল করিমের শেষ রচনার কথা—‘এই ভারতের কি স্বপ্ন দেখেছিলাম?’ ভাবনার দৈন্যভারে কুণ্ঠিত লজ্জিত দেশবাসী স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, ঐক্য ও মিলনের মূর্ত প্রতীক রেজাউল করিমের অনতিচর্চিত রচনার দিকে দৃষ্টিপাত করে যেন বলছেন, ‘‘তোমার আসন শূন্য আজি পূর্ণ কর, হে বীর, পূর্ণ কর।’’

আরও পড়ুন
Advertisement