নিমতিতা রাজবাড়ি। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
ছাদ ভেঙে পড়ছে। খসে পড়ছে দেওয়ালের ইট। নিমতিতায় গঙ্গা পাড়ের বিশাল জমিদার বাড়ি জুড়ে এখন আগাছার জঙ্গল। ভেঙে পড়েছে ঠাকুর দালান। এই দালান বাড়িতেই এক সময় সত্যজিৎ রায়ের জলসা ঘরের শুটিং চলেছে দিনের পর দিন। দীর্ঘ দিন এই ঠাকুর বাড়ির দালানেই কাটিয়েছেন ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর।
বহু ইতিহাসের সাক্ষী সেই নিমতিতা রাজবাড়িকে হেরিটেজ ভবন হিসেবে সংরক্ষণের পথে এগোল রাজ্য সরকার। ১৫৭ বছরের প্রাচীন এই রাজবাড়িকে হেরিটেজ সংরক্ষণের আওতায় আনতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবারের বর্তমান উত্তরসূরিরাও।
বৃহস্পতিবার রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের ওএসডি বাসুদেব মালিকের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘুরে দেখেন নিমতিতা রাজবাড়ি। প্রায় বিঘে পাঁচেক জমির উপর গড়া এই ভবনের প্রতিটি এলাকা ঘুরে দেখেন তাঁরা।
নিমতিতা এলাকার মানুষ জন রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানান জমিদারদের ভগ্নপ্রায় বাড়িটিকে হেরিটেজ ভবন হিসেবে সংরক্ষণের।
তাঁদেরই এক জন স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জুলফিকর আলি বলেন, “বহু দিন থেকে চেষ্টা চলছিল। জমিদার পরিবারের বংশধরেরাও রাজি। তাঁরাও লিখিত ভাবে তাঁদের আগ্রহের কথা জানান রাজ্য হেরিটেজ কমিশনকে। সেই সূত্রেই তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল নিমতিতায় এসে রাজবাড়ি ঘুরে দেখেন প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে। আশা করছি তাঁদের সম্মতি মিলবে। সে ক্ষেত্রে একটি ভাল পর্যটন কেন্দ্রও হয়ে উঠতে পারে এটি।”
রাজবাড়ির অন্যতম উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী ও তাঁর দাদা বর্তমানে কলকাতায় থাকেন।
এ দিন রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “আমরাও চেয়েছি এটিকে হেরিটেজ ভবন হিসেবে ঘোষণা করে এর উপযুক্ত সংরক্ষণ করুন হেরিটেজ কমিশন। তবে হেরিটেজ ভবন হিসেবে সুরক্ষা দিয়েই ভবনের সংস্কার ও সংরক্ষণ করতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের সম্মতিও দিয়েছে। বৃহস্পতিবার ভবন পরিদর্শনের পরে ভবনের নির্মাণ ইত্যাদি নিয়ে কিছু তথ্য চেয়েছে কমিশন। খুব শীঘ্র তা দেওয়া হবে।”
তিনি জানান, ১২৭২ বাংলা সন নাগাদ গৌরসুন্দর চৌধুরী তাঁর ভাই দ্বারকানাথ চৌধুরীর সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের আওতায় নিমতিতা এস্টেট নামে জমিদারি স্থাপন করেন। তখনই নির্মিত হয় এই ভবন। দ্বারকানাথের বড় ছেলে মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী কলকাতার নাট্য সমাজে পরিচিত ছিলেন। তিনি নিমতিতা হিন্দু থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে কলকাতার স্টার থিয়েটারের সমতুল্য একটি স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করেন সেখানে। সে বাড়িতে এসেছেন নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অপরেশ মুখোপাধ্যায়। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে কবি কাজী নজরুল ইসলামও এসেছেন সে বাড়িতে। সাহিত্যিক কবি অন্নদাশঙ্কর রায় সপরিবারে এক সপ্তাহ কাটিয়ে গিয়েছেন এই রাজবাড়িতে।
১৯৫৭ সালে সত্যজিৎ রায় জলসাঘর ছবির শুটিং করেন। পরে ১৯৫৯ এবং ১৯৬০ সালে দু’বার এসেছিলেন দেবী এবং সমাপ্তি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথ্যচিত্রের কিছু অংশ চলচিত্রায়নের জন্য।
রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের ওএসডি বাসুদেব মালিক বলেন, “এক সময়ের বহু নামী ভবনের এই দূরবস্থার কথা আমাদের জানা ছিল না। সব দেখেশুনে গেলাম। এটা প্রাথমিক পরিদর্শন। হেরিটেজ করতে কিছু পদ্ধতি ও নিয়ম রয়েছে। এই বাড়িটির স্থাপত্য যথেষ্ট সুন্দর। হেরিটেজ ভবনের স্বীকৃতি পাওয়ার মতো। এটিকে সংস্কার করাও খুব কঠিন কাজ।’’