‘ছেলেটাকে ওরা কত কষ্ট দিয়ে মারল!’

বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি ফাঁকাই ছিল। মা আদর কুণ্ডু ছিলেন রানাঘাটের মামাবাড়িতে। ভাইও সেখানে। বাড়িতে মৃতদেহ নিয়ে এসেছেন বাবা রামপ্রসাদ। সঙ্গে কয়েক জন আত্মীয়স্বজন।

Advertisement
সুস্মিত হালদার
বগুলা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৩ ০৮:৩৩
যাদবপুরের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া মৃত স্বপ্নদীপের শোকার্ত বাবা। বগুলায় বৃহস্পতিবার রাতে। ছবি: প্রণব দেবনাথ

যাদবপুরের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া মৃত স্বপ্নদীপের শোকার্ত বাবা। বগুলায় বৃহস্পতিবার রাতে। ছবি: প্রণব দেবনাথ

স্বপ্নদীপের শবদেহ শোয়ানো খাটের উপরে। তার একটা পায়া আস্তে আস্তে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন বাবা। তার পর আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘গোপাল..’ বলে চিৎকার। এক বার। সন্তানহারা বাবার বুকফাটা কান্না যেন ফালা-ফালা করে দিল মাঝরাতের নিস্তব্ধতা। বাবার মুখের কাছেই শোয়ানো ছেলের পায়ের পাতা দুটো। অল্প-অল্প কাঁপছে শবযাত্রীদের কাঁধের ঝাঁকুনিতে। পায়ের পাতায় লেগে তখনও শুকনো রক্ত। সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে বাবা রামপ্রসাদ কুণ্ডু বলে ওঠেন, “মাটিতে পড়ার পর বড্ড লেগেছে না, তোর?’’

Advertisement

বগুলা কুণ্ডুপাড়ায় স্বপ্নদীপের বাড়ির সামনের রাস্তায় তখন সহপাঠী, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের ভিড়। সকলের আদরের গোপাল তখন এগিয়ে চলেছে শ্মশানের দিকে। এক বার শেষ দেখা করার জন্য ভিড়ের মধ্যে থেকে এসে এগিয়ে আসার চেষ্টা। কেউ কেউ মোবাইলে তুলে রাখছে শেষ স্মৃতি।

স্বপ্নদীপের জন্যে বগুলায় মিছিল। নদিয়ার বগুলায়। ১১ আগস্ট ২০২৩।

স্বপ্নদীপের জন্যে বগুলায় মিছিল। নদিয়ার বগুলায়। ১১ আগস্ট ২০২৩। ছবি : সুদীপ ভট্টাচার্য।

কিছু ক্ষণ আগেই বাবা যত্ন করে, ছেলের বুকের উপরে, ফুলের মালার ঠিক মধ্যিখানে ছোট একটা গীতা রেখেছেন। কলকাতা থেকে দেহ আসার পর বাড়ির সামনের একচিলতে উঠোনে শুইয়ে রাখা হয়েছিল স্বপ্নদীপকে। গোটা এলাকা থমথমে। মাঝে-মধ্যে বাবার ডুকরে ওঠা কান্নার সঙ্গে বিলাপের শব্দ ভেসে আসে। রামপ্রসাদ ছেলের মৃতদেহে হাত বোলাতে থাকেন। মুখের ঢাকা সরিয়ে চেয়ে থাকেন একদৃষ্টিতে। তার পর আবার উঠে যান স্বপ্নদীপের আধার কার্ডের খোঁজে। দাহ করার সময় শ্মশানে জমা দিতে হবে যে।

বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি ফাঁকাই ছিল। মা আদর কুণ্ডু ছিলেন রানাঘাটের মামাবাড়িতে। ভাইও সেখানে। বাড়িতে মৃতদেহ নিয়ে এসেছেন বাবা রামপ্রসাদ। সঙ্গে কয়েক জন আত্মীয়স্বজন। স্বপ্নদীপের দেহ আসার খবর আগেই চলে এসেছিল। তাঁকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য জনা কয়েক সহপাঠী, বন্ধু রাস্তার উপরে অপেক্ষা করছিলেন। উঠোনে ভিড় করে ছিলেন প্রতিবেশীরা। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টা নাগাদ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় কলকাতা পুলিশের শববাহী গাড়ি। গাড়ির ভিতর থেকে নেমে আসেন রামপ্রসাদ কুণ্ডু। প্রতিবেশীদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পান না কেউই। সকলে মিলে ধরাধরি করে স্বপ্নদীপের মৃতদেহ গাড়ি থেকে নামিয়ে, বাড়ির সামনে রাখেন।

মৃতদেহ যেখানে শোয়ানো, ঠিক তার পায়ের দিক করেই স্বপ্নদীপের পড়ার ঘর। ঘরে খাটের উপরে, টেবিলে তখনও ছড়িয়ে প্রিয় বই। দেওয়ালে লাগিয়ে রাখা অঙ্কের সূত্র লেখা কাগজ। টেবিলের উপরে রাখা শুকিয়ে যাওয়া এঁটো বাসন। ছেলের বিপদের খবর পেয়ে খাওয়া ফেলেই ছুটে গিয়েছিল গোটা কুণ্ডু পরিবার।

ছোট একচিলতে ঘরের দেওয়ালে এসি। সেটা দেখিয়ে রামপ্রসাদ বলেন, “ছেলেটা গরমে কষ্ট পায় বলে অনেক কষ্ট করে এসিটা লাগিয়েছিলাম।... ছেলেটাকে ওরা কত কষ্ট দিয়ে মারল!”

সঙ্গে এসেছিলেন যাদবপুর থানার অফিসার। রানাঘাটেই তিনি বাবার বয়ান রেকর্ড করে নিয়েছিলেন। সেখানে হস্টেলের দুই ‘দাদা’ সৌরভ চৌধুরী ও মনতোশ মণ্ডলের নাম বলেছেন রামপ্রসাদ। অভিযোগ করেছেন, সৌরভের নেতৃত্বেই স্বপ্নদীপের উপরে অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে বিলাপের মধ্যেই রামপ্রসাদ বলেন, “সৌরভই আমায় কথা দিয়েছিল যে হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। ওর হাতেই ছেলেকে রেখে, নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এসেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ওই এমনটা করল! এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’’

কেটে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টা। স্বপ্নদীপকে শববাহী গাড়িতে তোলার প্রস্তুতি শুরু হতেই ছুটে আসেন রামপ্রসাদ। ছেলের মুখের থেকে কাপড় সরিয়ে মুখে-গালে হাত বুলিয়ে দেন। বলে চলেন, “এই মুখে খাবার তুলে দিতাম... এই মুখ আর কোনও দিন বুকে নেওয়া হবে না।”

রাত তখন প্রায় আড়াইটে। ভিতরে নিথর দেহ। শববাহী গাড়ি এগিয়ে যায় শ্মশানের দিকে। প্রিয় পড়ার টেবিল, পড়ার বই, স্বপ্নের আলোয় মোড়া ঘরটাকে পিছনে ফেলে।

আরও পড়ুন
Advertisement