শান্তিপুরের পুরপ্রধান সুব্রত ঘোষ (হাতে মোবাইল)। নিজস্ব চিত্র
দু’টি পুরসভা বিরোধীশূন্য, একটি পুরসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। দল আগাম জানিয়ে দিয়েছিল পুরপ্রধান ও উপ-পুরপ্রধান পদের প্রার্থীদের নাম। তবু নদিয়ার তিন পুরসভায় বোর্ড গড়তে হোঁচট খেল তৃণমূল। চাকদহ ও হরিণঘাটায় ‘প্রশাসনিক নির্দেশে’ পুরপ্রধান নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল। শান্তিপুরে আবার দলের মনোনীত প্রার্থীর বদলে শহর সভাপতিকে পুরপ্রধান করতে চেয়ে ভোটাভুটির পথে গেলেন কাউন্সিলরদের অর্ধেক। লক্ষ্যণীয়, তার মধ্যে দু’জন বিজেপি কাউন্সিলরও ছিলেন। এই ভোটাভুটির পরেই শান্তিপুর শহর সভাপতিকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
চাকদহে প্রাক্তন পুরপ্রধান দীপক চক্রবর্তী বা পুর প্রশাসক বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বপন গুপ্তকে পুরপ্রধান পদের জন্য মনোনীত করেনি দল। কলকে পাননি শংকর সিংহের ছেলে, দলের নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি শুভঙ্কর সিংহও। আদৌ কোনও আলোচনায় না থাকা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অমলেন্দু দাসকে পুরপ্রধান এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেবব্রত নাগকে উপ-পুরপ্রধান হিসেবে বেছে নেয় দল। এই নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই চাকদহে আলোড়ন চলছিল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কাউন্সিলরদের শপথগ্রহণ পর্ব মিটে যাওয়ার পরে প্রথা মতো পুরপ্রধান নির্বাচনের সভা শুরু হওয়ার বদলে হঠাৎই সব চুপচাপ হয়ে যায়। তৃণমূলের নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা সভানেত্রী রত্না ঘোষ, দলের কোঅর্ডিনেটর দীপক বসু প্রমুখ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সভা শুরু করার বদলে নেতানেত্রীদের মঞ্চ থেকে সরে গিয়ে ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। পে কল্যাণীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াসমিন বারি জানান, পদস্থ আধিকারিকদের নির্দেশে সভা স্থগিত করা হয়েছে। দলের কর্মীদের একটা বড় অংশের ধারণা, মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্য কারও নাম প্রস্তাব করে ভোটাভুটি রুখতেই সভা বানচাল করা হয়েছে। তবে দীপক বসু দাবি করেন, গোষ্ঠী বিবাদের জেরে নয়, প্রশাসনিক কারণেই পুরপ্রধান নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
প্রায় একই ঘটনা হরিণঘাটাতেও। সেখানে অবশ্য প্রাক্তন প্রধান ও পুরপ্রধানের নামই পছন্দের তালিকায় রেখেছিল দল, তবে পদ গিয়েছিল উল্টে। প্রাক্তন পুরপ্রধান রাজীব দালালকে উপ-পুরপ্রধান এবং প্রাক্তন উপ-পুরপ্রধান সঞ্জীব রাম পুরপ্রধান হবেন বলে জানানো হয়েছিল। সঞ্জীব রত্না ঘোষের ‘পছন্দের লোক’ এবং রাজীব রত্না-বিরোধী চঞ্চল দেবনাথের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
দলীয় সূত্রের খবর, বিরোধীশূন্য এই ১৭ আসনের পুরসভায় এ বার চঞ্চল-গোষ্ঠীই দলে ভারী। অর্থাৎ পুরপ্রধান পদের জন্য ভোটাভুটি হলে দলের মনোনীত সঞ্জীব রামের জেতা কঠিন হত। শপথগ্রহণের পরে অবশ্য পুলিশের আপত্তিতে প্রধান নির্বাচনের সভা বানচাল হয়ে যায়। রত্না ঘোষের দাবি, “আমার কোনও গোষ্ঠী নেই। নিশ্চয়ই প্রশাসনিক সমস্যা হয়েছিল বলেই সভা স্থগিত হয়েছে।” একাধিক বার ফোন করা হলেও চঞ্চল দেবনাথ তা ধরেননি।
রানাঘাট পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার (সদর) শৌভনিক মুখোপাধ্যায় বলেন, “সতীমায়ের মেলা এবং ৭ জায়গায় বোর্ড গঠন ছিল। তার উপর শুক্রবার দোল, হোলি ও সবেবরাতের জন্য অর্ধেক পুলিশ বাহিনী ১০টি থানা এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। তার ফলে হরিণঘাটায় যতটা পুলিশি ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেটা পর্যাপ্ত বলে মনে হয়নি।” কোনও গন্ডগোল ছিল কি? অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) বলেন, “কোনও বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কিন্তু হতে পারত। সেই জন্য প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সভা স্থগিত করা হয়েছে।”
শান্তিপুরে ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টিতে তৃণমূল এবং ২টিতে বিজেপি জয়ী হয়েছে। দলের তরফে পুরপ্রধান পদের জন্য প্রাক্তন পুর প্রশাসক বোর্ডের চেয়ারম্যান সুব্রত ঘোষকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শপথের পর পুরপ্রধান নির্বাচনের সভা শুরু হতেই কাউন্সিলরদের মধ্যে থেকে শান্তিপুর শহর সভাপতি বৃন্দাবন প্রামাণিকের নামও প্রস্তাব করা হয়। ভোটাভুটির পর দেখা যায়, দু’জনেই ১২টি করে ভোট পেয়েছেন। সভার সভাপতিত্ব করছিলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক ব্রজকিশোর গোস্বামীর বাবা, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রশান্ত গোস্বামী। দু’পক্ষের ভোট সমান হলে সভাপতি নির্ণায়ক ভোট (কাস্টিং ভোট) দিতে পারেন। প্রশান্তবাবুর ভোটে পুরপ্রধান হন সুব্রত। ভোট প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ঘর ছেড়ে চলে যান বৃন্দাবন। খানিক পরে তিনি সমাজমাধ্যমে শান্তিপুর শহর সভাপতির পদ থেকে ইস্তফার কথা জানান। তবে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে পদ থেকে অপসারণের কথা জানিয়েছেন।
বৃন্দাবনের বক্তব্য, “দলের অনেক কাউন্সিলর আমাকে পুরপ্রধান চেয়ে নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ১২ জন কাউন্সিলর আমাকে ভোট দিয়েছেন। আমি শহর সভাপতি দায়িত্ব পাওয়ার পর কঠোর পরিশ্রম করেছি। দু’টি কঠিন নির্বাচনে বড় সাফল্য এসেছে। নৈতিক কারণেই আমার সরে যাওয়া উচিত বলে মনে করেছি।” পুরপ্রধান সুব্রত বলেন, “এটা অপ্রত্যাশিত এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।”
দু’জন বিজেপি কাউন্সিলর এই ভোটাভুটিতে যোগ দিলেন কেন? তাঁদের ভোট কার দিকে গিয়েছে? দলের নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওখানে কী হয়েছে, তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।” যদিও একে তৃণমূল আর বিজেপির আঁতাঁত বলেই দেখছে সিপিএম। দলের জেলা কমিটির সদস্য সৌমেন মাহাতো বলেন, “নীতিহীন রাজনীতি আর পুরসভায় লুটপাটের প্রতিযোগিতা চলছে। এ ক্ষেত্রে যে তৃণমূল আর বিজেপি একে অন্যের দোসর, তা স্পষ্ট হল।”