ফাইল চিত্র।
দীর্ঘদিন স্কুল ছাড়া ছাত্রছাত্রীরা। পঠন পাঠন বন্ধ। পরীক্ষা না দিয়েই মূল্যায়ন ছাড়াই পরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়েছে সকলকেই। করোনা আবহে এবার তাই ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য “দুয়ারে স্কুল” কর্মসূচি নিয়ে এল জঙ্গিপুরের এক হাইস্কুল। প্রতি গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় সেই পাঠদানে হাজির থাকবেন স্কুলেরই বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকেরা।
মুর্শিদাবাদের জোতকমল হাইস্কুল শুক্রবার থেকে শুরু করল দুয়ারে পাঠদানের এই কর্মসূচি ফাদিলপুর গ্রাম থেকে। বিভিন্ন শ্রেণির ৩২ জন ছাত্র ছাত্রী হাজির ছিল এদিন। হাজির প্রধান শিক্ষক অঙ্কের শিবশঙ্কর সাহা, জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার শিক্ষক শেখর চট্টোপাধ্যায়, ইতিহাসের সুবীর দাস, বিজ্ঞানের শিক্ষক সমর দাস,সোমনাথ দত্ত। হাজির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অষ্টম শ্রেণির অরিত্র শীল, দ্বাদশ শ্রেণির রিম্পা ঘোষ, অঙ্কিতা শীল, একাদশ শ্রেণীর রাখি ঘোষ সহ পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অনেকেই।
প্রধান শিক্ষক বলছেন, ‘‘প্রায় দেড় বছর স্কুলে আসা বন্ধ ছাত্র ছাত্রীদের। স্কুলে থাকলে তারা পড়াশোনার একটা গাইডলাইন পায়। বুঝতে না পারা প্রশ্নের উত্তর পায়। নিয়মিত পরীক্ষা দিয়ে তাদের অগ্রগতির মূল্যায়ন হয়। গ্রামের স্কুলগুলিতে অধিকাংশেরই কোনও টিউশনি নেই। বাবা, মায়েরাও সেভাবে শিক্ষিত নয়। ফলে অথৈ জলে পড়েছে বহু ছাত্রছাত্রী। কদিন আগেই স্কুলে এসেছিল কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী। তাদের মুখেই শুনি পঠন পাঠনে তাদের সমস্যার কথা। তারপরই শিক্ষকেরা বসে সিদ্ধান্ত নিই এলাকার গ্রামগুলিতে গিয়ে পাঠদানের।”
তিনি জানান, গরিব এলাকা। রাজমিস্ত্রি, দিনমজুর, বিড়ি শ্রমিকদের ঘরের ছেলে মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি। স্কুলে প্রায় ৩৭শো ছাত্র ছাত্রী। শিক্ষকও আছেন ৪৪ জন। স্কুলে পঠন পাঠন বন্ধ। শিক্ষকদেরও খারাপ লাগছে। অনেকেই চাইছেন পঠন পাঠনের পরিবেশ আবার ফিরে আসুক স্কুলে। কিন্তু বাধ সেধেছে করোনা।
প্রতি গ্রামে ২ /৩ শো করে ছাত্র ছাত্রী। তাদের অর্ধেকও যদি শিবিরে আসে সংখ্যাটা কম নয়। করোনা আবহে সে জমায়েত হলেও বিপদ। তাই প্রতি পাড়ায় পাড়ায় পাঠদানের শিবির করার পরিকল্পনা, যাতে উপস্থিতির হার ৩৫-এর বেশি না ছাড়ায়। দুয়ারে স্কুলকে এনে পাঠদানের শিবির শুক্রবার সকালে বসেছিল ফাদিলপুরে।
শনিবার হবে পিয়ারাপুরে, পরদিন বাঁধের ধার, সাইদাপুর, জাগুনপাড়া, ওসমানপুর। এই ভাবেই স্কুলকে নিয়ে যাওয়া হবে গ্রামের প্রতিটি পাড়ায়। শিশু সংসদ রয়েছে জোতকমল হাইস্কুলে। সেই সংসদের প্রধানমন্ত্রী দেবলীনা ঘোষের উপর দায়িত্ব ছিল ফাদিলপুরে এদিনের পাঠ দান শিবিরের আয়োজনের। বলে দেওয়া হয়েছিল এই করোনা আবহে কারও বাড়িতে এই আয়োজন করে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। তাই এদিনের ক্লাস বসেছিল একটি সদ্য নির্মিত ফাঁকা বাড়িতে। একাধিক ঘরে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকেরা ক্লাস নিয়েছেন ছাত্র ছাত্রীদের। কারও দুর্বলতা অঙ্কে। সে বসেছে প্রধান শিক্ষকের কাছে, কারণ তিনিই অঙ্কের শিক্ষক।রিম্পা,অঙ্কিতাদের দুর্বল জায়গা বাংলা।তারা বসেছে শেখরবাবুর ঘরে।অষ্টম শ্রেণির অরিত্রকে পাওয়া গেল জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষকের ঘরে।
অরিত্র বলছে,“জীবন বিজ্ঞান আর অঙ্ক দুটোই আমার কাছে সমস্যা।এর সঙ্গে ইংরেজির শিক্ষক যদি আজ থাকতেন তবে খুব ভাল হত।” জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক গণেশবাবু বলছেন, “আজকে ছাত্রদের মুখোমুখি হয়ে বুঝলাম সত্যি, ওরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায়। এটা কাটাতে ওদের সঙ্গে স্কুলের শিক্ষকদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। প্রত্যেকের ফোন নম্বর নেওয়া হচ্ছে। পঠন পাঠনে কোনও বড় সমস্যায় পড়লে ছাত্ররা পরদিন অন্য পাড়ার শিবিরে গিয়ে বা ফোনে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।”
প্রধান শিক্ষক বলেন, “সমস্ত শিক্ষকই এই শিবিরগুলিতে আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। স্কুল থাকলে ক্লাস তো করতেই হত। এটাকেও ক্লাস বলেই ভাবতে হবে। কারণ স্কুল না থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের। পঠন পাঠনের সেই ক্ষতিপূরণের দায়িত্বও নিতে হবে শিক্ষকদেরই। আমরা শুরু করেছি। অন্যস্কুলগুলিতেও তা চালু হলে ছাত্ররা উপকৃত হবে। কারণ মফসসলে স্কুলগুলিতে অনলাইনে ক্লাস করার পরিকাঠামো নেই। স্মার্ট ফোনও নেই সকলের ঘরে। তাদের কাছে অনেকটাই ভরসা জোগাবে দুয়ারে স্কুলকে নিয়ে গিয়ে পাঠদানের এই শিবির।”