অশান্ত মুর্শিদাবাদ। নিজস্ব চিত্র।
ক'দিন আগে শহরের পথে বিভিন্ন কাজে ঘোরাঘুরি করছি, হঠাৎ কানে ভেসে এল প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী গান, ‘‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল।’’
থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, সত্যিই তো এ বাংলা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলা। যে ধর্মেরই হোক, ভাইয়ে ভাইয়ে বেঁধে বেঁধে থাকাই এই বাংলার ঐতিহ্য। রবি ঠাকুর যেমন তাঁর ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় বিভেদের বিরোধিতা করলেন, নজরুল গাইলেন সম্প্রীতির গান ‘‘মোরা, এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।’’
এই বাংলার একটি সুপ্রাচীন ইতিহাস বিজড়িত জনপদ মুর্শিদাবাদ। বাংলার সম্প্রীতির ঐতিহ্য এখানেও শত সহস্রধারায় প্রবাহিত। মুর্শিদাবাদ যেমন নবাব সিরাজের, তেমনই এই মাটি মীরমদনের। আজন্মকাল আমরা এখানে দেখে আসছি দুই ধর্মের মেলবন্ধন। মুর্শিদাবাদে যেমন মহরম, বেরা উৎসবের মেলায় অগণিত হিন্দু ভাই অংশগ্রহণ করেন, তেমনই রথের মেলা, চড়কের মেলা, দোল উৎসব, হরিনাম সংকীর্তনের আসরেও অগণিত সংখ্যালঘু ভাই যোগ দেন। ফজরের নামাজের আজানধ্বনি ঘুম ভাঙায় হিন্দু পড়শির, মন্দিরের বেহাগ রাগ বা মঙ্গলারতি জাগিয়ে তোলে মুসলিম প্রতিবেশীদের। ভাদ্র মাসে মা মনসার গান, চৈত্রে বোলানে মুসলিম শিল্পীরা সানন্দে যোগ দেন, মুসলিম ঘরানার লোকগান ‘গুনাই’, ‘রূপভান কন্যা’, ‘কাজল রেখা’ ইত্যাদিতে দিব্যি অভিনয় করেন হিন্দু লোকশিল্পীরা। জেলার ঐতিহ্যপূর্ণ লোকগান আলকাপ তো হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের মানুষের জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিককে ফুটিয়ে তোলে। এগদিল গানও আমরা শুনে এসেছি ছোট থেকে।
আমাদের প্রান্তিক মুর্শিদাবাদ জেলায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে সমস্যা অনেক। হাসপাতালগুলোতে রক্তের পর্যাপ্ত জোগান থাকে না। বিশেষত রমজান মাসে রক্তের জোগান খুব কম থাকে, রক্তদান শিবির অনুষ্ঠিত হয় কম। কিন্তু বার বার দেখা গিয়েছে রোজদার ভাইয়েরা রোজা ভেঙে হিন্দু ভাইবোনদের রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। ভূমিহীন মুসলিম বৃদ্ধের কবর খোঁড়া হল স্বচ্ছল হিন্দু বাল্যবন্ধুর মাটিতে, দরিদ্র অসহায় হিন্দু বৃদ্ধার শ্মশান যাত্রায় সবাই মুসলিম, এ ঘটনা মুর্শিদাবাদে বিরল নয়।
সুতরাং এ কথা বলাই যায় যে, মুর্শিদাবাদ নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের আজন্মকাল লালিত সম্প্রীতির ঐতিহ্য বহন করে। তাই এই কৃষ্টি ধরে রাখার দায়িত্বও এই সব ধর্মাবলম্বী মানুষের। সম্প্রতি কেন্দ্র সরকারের আনা ওয়াকফ বিল নিয়ে জেলায় যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা কখনই অভিপ্রেত নয়। সরকারের কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু সেই আন্দোলন করতে হবে গণতান্ত্রিক পথেই, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস বা প্রাণহানি ঘটিয়ে নয়। কেউ কোনও গুজবে কান দেবেন না, গুজব ছড়াবেন না। সমাজমাধ্যমে যেন কোনও গুজব না ছড়ায়, তা দেখার দায়িত্ব এই জেলার মানুষেরই। যে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান প্রশাসনের সহযোগিতায়।
লেখক সহকারী শিক্ষক