প্রতীকী ছবি।
প্রয়াত বিধায়কের নামে স্কুলের জমিতে শিশু উদ্যান তৈরির চেষ্টায় বাধা পেয়ে প্রধান শিক্ষককে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ উঠল স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
নদিয়ার হাঁসখালি ব্লকে দক্ষিণপাড়া রাধাসুন্দরী পালচৌধুরী বিদ্যাপীঠের টিচার্স রুমে ঢুকে পড়ুয়া ও অন্যান্য শিক্ষকদের সামনেই প্রধান শিক্ষক সুভাষ মণ্ডলকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে হাঁসখালি পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী মুনমুন বিশ্বাসের স্বামী দেবাশিস বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। জেলা স্কুল পরিদর্শকের কাছে শুক্রবার লিখিত ভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আর স্কুলে যাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। এই স্কুলটিই হাঁসখালিতে মাধ্যমিকের ‘মেন সেন্টার’। সোমবার, মাধ্যমিক শুরুর দিন প্রধান শিক্ষক স্কুলে না এলে পরিস্থিতি জটিল আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষকেরা।
২০১৯ সালে সরস্বতী পুজোর আগের রাতে হাঁসখালিতে নিজের বাড়ির কাছেই আততায়ীর গুলিতে খুন হন কৃষ্ণগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস। তিনি রাধাসুন্দরী পালচৌধুরী বিদ্যাপীঠের করণিক ছিলেন। এই স্কুলের জন্য জমি দান করেছিল পালচৌধুরী পরিবার। স্কুলের পাশে হাট বসত। স্কুল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে হাট চালানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে জমিটি স্কুলের নামে লিখে দিয়েছিলেন পালচৌধুরীরা। খাজনার বিনিময়ে ওই জমিতে হাট বসতে দিত স্কুল। পরে হাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমি ফাঁকাই পড়ে ছিল। এখন সেখানে সত্যজিতের নামে সেখানে শিশু উদ্যান করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু তাঁরা বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারায় প্রধান শিক্ষক বাদ সেধেছেন।
বছর আড়াই আগে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন সুভাষ মণ্ডল। তার আগেই সত্যজিৎ নিহত হয়েছেন। তৃণমূলের নেতাদের দাবি, বিধায়ক বেঁচে থাকতেই স্কুলের ফাঁকা জমিতে উদ্যান করার জন্য পরিচালন সমিতির বৈঠকে লিখিত সিদ্ধান্ত (রেজ়োলিউশন) হয়েছিল। এখনও সেই উদ্যানই তাঁর নামে করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তেমন কোনও নথি স্কুলে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ওই নেতারাও তা দেখাতে পারেননি। উল্টে পরিচালন সমিতির বৈঠক ডেকে জমি দেওয়ার লিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাঁরা প্রধান শিক্ষককে চাপ দিতে থাকেন, এমনকি নানা ভাবে হুমকিও দেওয়া হতে থাকে বলে অভিযোগ। তাতেও তাঁকে বাগে আনা যায়নি। এর পরেই বৃহস্পতিবার বলপ্রয়োগের রাস্তা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
প্রধান শিক্ষক সুভাষ মণ্ডলের অভিযোগ, “আমি স্কুলে ঢুকে দেখি, প্রচুর লোকজন দাঁড়িয়ে। আমি টিচার্স রুমে ঢুকে যাই। সেখানে আমাকে কোনও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মারধর শুরু হয়। দেবাশিস বিশ্বাস আমার ফোন কেড়ে নিতেই অনেকে মিলে চড়-ঘুষি মারতে থাকে।” এর পর তাঁকে ঘরে আটকে রেখে চাপ দিয়ে রেজ়োলিউশনে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ।
এই হামলার পরে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাইছেন না প্রায় কেউই। ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ পাল বা স্টাফ কাউন্সিলের সম্পাদক প্রশান্ত বিশ্বাসেরা বলছেন, “পার্কের জমি নিয়ে সমস্যা চলছিল। সেটা নিয়েই গন্ডগোল হয়। আমরা তখন ক্লাসে ছিলাম বলে নিজের চোখে দেখিনি। তবে শুনেছি কিছু বাইরের লোক এসে প্রধান শিক্ষককে মারধর করেছে।” প্রধান শিক্ষক বলছেন, “ওরা আমাকে খুনের হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে। নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি না পেলে আমি স্কুলে যাই কী করে?” যদিও শুক্রবার রাত পর্যন্ত পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি তিনি। মূল অভিযুক্ত দেবাশিস বিশ্বাস আবার গোটা বিষয়টিই অস্বীকার করছেন। তাঁর দাবি, “প্রধান শিক্ষক ছাড়া পরিচালন সমিতির সকলেই জমিটা হস্তান্তর করতে রাজি। উনি ইচ্ছা করে সেটা আটকে রাখায় স্থানীয় মানুষজন খেপে গিয়ে স্কুলে কথা বলতে যায়। তবে ওঁকে কেউ মারধর করেনি।” তিনি তখন সেখানে কী করছিলেন? দেবাশিসের দাবি, “অশান্তি হতে পারে অনুমান করে স্কুলে গিয়েছিলাম। আমি না থাকলে উনি সত্যিই মার খেতেন।”
ওই ঘটনার সময়ে স্কুলে উপস্থিত ছিলেন পরিচালন সমিতির সভাপতি অমিত পাল। তিনি বলেন, “জমিটা দিতে গেলে সব কিছু আগে ভাল করে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। আমি প্রধান শিক্ষককে নিয়ে সোমবার ব্লক অফিসে গিয়ে সবটা জানার চেষ্টা করি। কিন্তু বুধবার প্রধান শিক্ষক স্কুলে আসতেই তাঁর উপর হামলা হয়।” প্রধান শিক্ষক বলছেন, “আমি যদি আইনকানুন না মেনে জমি হস্তান্তর করে দিই, তা হলে তো আমাকেই পরে দফতরের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। তাই আমি সব দিক দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছি।”
প্রধান শিক্ষক সংগঠন ‘অ্যাডভান্স সোসাইটি ফর হেডমাস্টারস অ্যান্ড হেডমিসট্রেসেস’-এর নদিয়া জেলা কমিটির সম্পাদক শান্তনু মণ্ডল বলছেন, “স্কুলে ঢুকে এক জন প্রধান শিক্ষককে মারধর করা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যদি এমনটা ঘটে থাকে, আমরা তীব্র নিন্দা করছি। রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ করব।” নদিয়া জেলা স্কুল পরিদর্শক দিব্যেন্দু পাল বলেন, “গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাব।”
কী বলছে শাসক দল তৃণমূল?
তৃণমূলের মুখপাত্র বাণীকুমার রায়ের মতে, “যা ঘটেছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়।” তিনি বলেন, “ওই স্কুলে জমি নিয়ে জটিলতার কথা আমি জানি। প্রধান শিক্ষককে বলেছিলাম, আইন মেনে যাবতীয় কাজ করতে। স্কুলে ঢুকে মারধরের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, দল ব্যবস্থা নেবে।”
নিহত বিধায়কের স্ত্রী রূপালী বিশ্বাসকে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে রানাঘাট কেন্দ্রে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল, যদিও তিনি হেরে যান। স্বামীর স্কুলেই তিনি চাকরি পেয়েছেন। একাধিক বার ফোন করা সত্ত্বেও রূপালী তা ধরেননি।