Mangrove Plants

উপকূলে প্রাকৃতিক ঢালে অবহেলার ছিদ্র

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র তেমন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু তিন বছর পরেও ‘ইয়াস’এর ক্ষত এখনও স্পষ্ট উপকূল জুড়ে।

Advertisement
কেশব মান্না
দিঘা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২৬
কমে যাচ্ছে মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া লাগানো ম্যানগ্রোভ।

কমে যাচ্ছে মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া লাগানো ম্যানগ্রোভ। ছবি: শুভেন্দু কামিলা।

কমে যাচ্ছে মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া লাগানো ম্যানগ্রোভ । দীঘা মোহনা সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ এলাকায় তোলা। ছবি শুভেন্দু কামিলা

Advertisement

বাঁচছে সুন্দরবন। প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশা বা পড়শি বাংলাদেশও রক্ষা পায়। ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে তাদের ঢাল হয়ে দাঁড়ায় ম্যানগ্রোভ অরণ্য। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ সেই ম্যানগ্রোভ অরণ্য অবহেলিত। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ম্যানগ্রোভের চারা।

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র তেমন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু তিন বছর পরেও ‘ইয়াস’এর ক্ষত এখনও স্পষ্ট উপকূল জুড়ে। আমপান, ইয়াসের অভিজ্ঞতা থেকে ম্যানগ্রোভের গুরুত্বের কথা বার বার উঠে এসেছে। দিঘা-সহ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় বাঁধের ভাঙন রুখতে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় প্রতি বছর ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়। কিন্তু অভিযোগ, সে সব রক্ষা করা যাচ্ছে না।

কাঁথি মহকুমার বিভিন্ন ব্লকের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা এবং নদীর চরে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়েছে। রামনগর-১ ব্লকের পদিমা-২ পঞ্চায়েত এলাকার সমস্ত সমুদ্র বাঁধই বিপজ্জনক। দিঘা মোহনার অদূরে মৈত্রাপুর, বেগুনাডিহা এবং আটিলি চরে 'ইয়াস’এর পরে সরকারি উদ্যোগে কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, কিছু কিছু অংশে গাছের অস্তিত্বই নেই। চারদিকে শুধু কাঁটাতার দিয়ে বেড়া।

এই পঞ্চায়েতের কিছুটা দূরে ম্যানগ্রোভের চারা লাগানো হয়েছিল। সেগুলো জাল ও বেড়া দিয়ে ঘিরেও দেওয়া হয়। তবে এখন জাল-চারা কিছুই নেই। হাতে গোনা কিছু কাঁকড়া জাতীয় ম্যানগ্রোভ ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঁকি দিচ্ছে। একই অবস্থা এই পঞ্চায়েতের দিঘার প্রবেশপথের পাশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভের ন্যায়কালী মন্দিরের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার পাশে। এই রাস্তায় কংক্রিটের বাঁধের ধারে এক সময় লাগানো হয়েছিল কাঁকড়া, গেওয়া, সুন্দরী এবং গামা গাছ। এখন অনেকাংশই ফাঁকা।

এই ব্লকের পদিমা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবশ্য প্রাকৃতিক ভাবে কিছু কাঁকড়া জাতীয় গাছ বড় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রোপণের সমস্ত টাকা কার্যত জলে গিয়েছে। পদিমা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান তথা তৃণমূলের রামনগর-১ ব্লক সভাপতি উত্তম দাস বলেন, ‘‘কিছু কিছু ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয়েছে বিভিন্ন কারণে। রোপণের সময় কিছু কিছু মরা ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। তবে অনেক জায়গায় ম্যানগ্রোভ বেঁচে আছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে সব ম্যানগ্রোভ বাঁচানো যায়। এ বিষয়ে বন দফতরের পরামর্শ নেওয়া হয়। রক্ষণাবেক্ষণের উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে।’’

২০২১ সালের ২৮ জুলাই বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস সাড়ম্বরে পালিত হয়েছিল এই এলাকায়। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে লাগানো হয়েছিল ম্যানগ্রোভ চারা। কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের ভোগপুর, বাকিপুট এবং নন্দীগ্রামের জেলিংহ্যামে কয়েক বছর আগে লাগানো হয়েছিল ম্যানগ্রোভ। হলদি নদীর জলের তোড়ে জেলিংহাম এলাকায় বেশ কিছু ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয়েছে। বাকি গাছ অনেকটাই বড় হয়েছে। ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, ম্যানগ্রোভ রোপণের ক্ষেত্রে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমে চারা কিনে বসানোর নিয়ম নেই। বীজই রোপণ করতে হয়। কিন্তু পরিবেশবিদ সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নদীর চরে বীজ ছড়ানোর থেকে চারা লাগানো বেশি কার্যকর।’’

জেলায় এক হাজার হেক্টর জমিতে ম্যানগ্রোভের চারা লাগানো হয়েছে। শুধু ২০২১ সালে লাগানো হয়েছে ৫০০ হেক্টর জমিতে। যার অধিকাংশই কাঁথি মহকুমার উপকূলবর্তী এলাকায় রয়েছে। ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, এক একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বীজ লাগাতে সব মিলিয়ে খরচ ধরা হয় প্রায় ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয় বীজের জন্য। বাকি টাকা বীজ রোপণ, বেড়া দেওয়া-সহ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে খরচ হয়। বন দফতর সূত্রে খবর, ম্যানগ্রোভ রোপণ কর্মসূচি সফল করতে ন্যূনতম তিন বছর সময় লাগে। কিন্তু একশো দিনের কাজের প্রকল্পে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা মেলেনি বলে অভিযোগ রাজ্য সরকারের। তার ফলে মার খাচ্ছে উপকূল এলাকায় ম্যানগ্রোভ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার কাজ।

প্রতি বছর এত টাকা খরচ করা হলেও আখেরে কোনও লাভ হচ্ছে না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। রামনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি তথা জেলা পরিষদ সদস্য শম্পা মহাপাত্র বলেন, ‘‘সরকারি নিয়ম মেনে ম্যানগ্রোভ বীজ কিনে রোপণ করা হয়েছিল। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা রক্ষণাবেক্ষণ করেন। বন দফতর এবং ব্লক প্রশাসন নিয়মিত খোঁজখবর রাখে। কিছু ক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভ বাঁচানো যাচ্ছে না, তা ঠিক।’’

এ ব্যাপারে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বন আধিকারিক সত্যজিৎ রায়ের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ফোন করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। তবে দিঘার নতুন বিট অফিসার সুব্রত মিত্র বলেন, "খোঁজ নিয়ে দেখছি। কী করে বাঁচানো যায় তার চেষ্টা করব।’’

আরও পড়ুন
Advertisement